অর্থঋণ আদালতে মামলা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ও বিচার পদ্ধতি
লিখেছেন সোয়েবুর রহমান সোয়েব অ্যাডভোকেট, কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতি
বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। আইনটির ৩ ধারার ক্ষমতাবলে অন্যসব আইনের তুলনায় এ আইনটির প্রাধান্য রয়েছে। আবার ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮-এর যতটুকু অংশ এ আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, ঠিক ততটুকুই এ আইনের অধীনে মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলায় এক বা একাধিক অর্থ ঋণ আদালত আছে। যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচারক সাধারণত অর্থ ঋণ আদালতের বিচার কাজ করে থাকেন। সরকার এসব বিচার কাজ করার জন্য ২০০৩ সালে অর্থ ঋণ আদালত আইন প্রণয়ন করে। আইনানুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায় সম্পর্কিত যাবতীয় মামলা এ আদালতে দায়ের করতে হয়।
অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর অধীনে মামলা, মধ্যস্থতা ও বিচারের কিছু কিছু ক্ষেত্রের পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে, আর যেসব ক্ষেত্রে বিচার পদ্ধতির বর্ণনা পাওয়া যায় না সেই ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধি প্রয়োগ করা হয়।
মামলা দায়েরের নিয়ম মামলার বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালত আইনের ধারা ৮(১) অনুযায়ী আরজি দাখিলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। এ ধরনের মামলার আরজিতে উপস্থাপন করতে হবে : বাদী-বিবাদীর নাম, ঠিকানা, কর্মস্থল, বাসস্থানের ঠিকানা, দাবির সঙ্গে সম্পর্কিত সব ঘটনা, কোর্ট ফি প্রদানের উদ্দেশ্যে মামলার মূল্যমান, আদালতের এখতিয়ার আছে এ মর্মে বিবরণ এবং প্রার্থিত প্রতিকার। অন্যদিকে ওই আরজিতে দুটি তফসিল থাকবে।
প্রথম তফসিলে থাকবে বিবাদীকে প্রদত্ত মূল ঋণ অথবা বিনিয়োগকৃত টাকার পরিমাণ; স্বাভাবিক সুদ/মুনাফা/ভাড়া হিসেবে আরোপিত টাকার পরিমাণ; দণ্ড সুদ হিসেবে আরোপিত টাকার পরিমাণ; অন্যান্য বিষয় বাবদ বিবাদীর ওপর আরোপিত টাকার পরিমাণ; মামলা দায়েরের আগ পর্যন্ত প্রণীত শেষ হিসাবমতে বিবাদী কর্তৃক বাদীর আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বা পাওনা পরিশোধ বাবদে জমাকৃত টাকার পরিমাণ; বাদী কর্তৃক প্রদত্ত ও ধার্য মোট এবং বিবাদী কর্তৃক পরিশোধিত মোট টাকার তুলনামূলক অবস্থান।
দ্বিতীয় তফসিলে থাকবে, ওইসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি যা বন্ধক বা জামানত রেখে বিবাদী ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। সে সম্পত্তির বিস্তারিত বিবরণ ও আর্থিক মূল্য সেখানে উল্লেখ করতে হবে এবং প্রত্যাশিত প্রতিকার চেয়ে একটি হলফনামা লিখে প্রদত্ত ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতের বিচারক বরাবর এ মামলাটি দাখিল করা যাবে। সেই সঙ্গে মূল্যানুপাতিক কোর্ট ফি প্রদান করতে হবে। আরজিটি যথাযথ হলে অর্থঋণ মামলা হিসেবে নির্ধারিত রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যেসব জেলায় এরকম আদালত নেই সেখানে যুগ্ম জেলা জজের আদালতে দাখিল করতে হবে ধারা ৪(৩) অনুসারে এবং দাখিলকৃত আরজি যথাযথ হলে আদালতের রেজিস্ট্রার নির্ধারিত নিবন্ধন বইতে ক্রমানুসারে তা অন্তর্ভুক্ত করবেন।
মনে রাখতে হবে, এ আইনের মাধ্যমে গঠিত মামলায় বাদী ও বিবাদী নিজেদের আরজী-জবাবে (Pleadings) তাদের দাবির সমর্থনে কোনো সাক্ষ্য অথবা দলিল উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে আদালত সঙ্গত কারণ ও খরচ প্রদান ছাড়াই ওই সাক্ষ্য ও দলিল গ্রহণ না-ও করতে পারে। সুতরাং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এসব সাক্ষ্য ও দলিলপত্রাদি সংযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে যেসব সাক্ষ্য অথবা দলিল বাদী অথবা বিবাদীর কাছে মজুদ নেই, সেসব সাক্ষ্য ও দলিলের সম্ভাব্য উৎসের বিবরণও আরজিতে উল্লেখ করতে হবে। কারণ এই আইনের ৬(৪) ধারায় বলা হয়েছে, আদালত চাইলে এ ধারার উপধারা ২ ও ৩ বিধান অনুযায়ী সংযুক্ত হলফনামাই মৌলিক সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে এবং আদালত চাইলে কোনো মামলার এরকম হলফনামাযুক্ত আরজি বা লিখিত জবাব ও সংশ্লিষ্ট দলিলাদি বিশ্লেষণ করে এবং কোনো সাক্ষীকে পরীক্ষা করা ছাড়াই একতরফাভাবে রায় বা আদেশ প্রদান করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, যে ক্ষেত্রে ঋণের বিপরীতে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই মামলা দায়েরের পূর্বে ধারা ১২ এর বিধান সাপেক্ষে বন্ধককৃত সম্পত্তি নিলামের মাধ্যমে বিক্রয়ের চেষ্টা করতে হবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছে ১২(৩) ধারায়। উক্ত ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিবাদীর কাছ থেকে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে অথবা অস্থাবর সম্পত্তি দায়বদ্ধ রেখে ঋণ প্রদান করলে এবং বন্ধক প্রদান বা দায়বদ্ধ রাখার সময় বন্ধকি বা দায়বদ্ধ সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়ে থাকলে, তা বিক্রি না করে এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ ঋণ পরিশোধ বাবদ সমন্বয় না করে অথবা বিক্রির চেষ্টা করে ব্যর্থ না হয়ে এই আইনের অধীনে অর্থঋণ আদালতে কোনো মামলা দায়ের করা যাবে না।’ অর্থাৎ যদি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কোনো সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা দিয়ে কোনো সম্পত্তি বন্ধক দেয়া হয়, তাহলে ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠান সেই সম্পত্তি বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ ঋণ পরিশোধ বাবদ সমন্বয় করার চেষ্টা করবে। এতেও যদি ঋণ না মেটে কিংবা সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করে যদি প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ হয়, কেবল তখনই অর্থঋণ আদালত মামলা দায়ের করা যাবে।
এই আইনে বিবাদী মূল ঋণ গ্রহীতা কিংবা ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা এবং তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টরকেও বিবাদী শ্রেণিভুক্ত করে মামলা করতে হবে। অর্থাৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান মূল ঋণগ্রহীতার (Principal debtor) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সময় তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা (Third party mortgagor) বা তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর (Third party guarantor) ঋণের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলে, তাদেরকেও পক্ষ করতে হবে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ‘এহতেশামুল হক বনাম রাষ্ট্র’ এবং অন্যান্য মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ১১.১১.২০১২ তারিখে মন্তব্য করে, হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ সালের ১৩৮ ধারার মামলার পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করতে আইনগত কোনো বাধা নেই।
সমন জারি বিবাদী বা বিবাদীদের প্রতি সমন জারি করতে হবে। এই আইনের ৭ ধারায় সরাসরি, বিকল্প পদ্ধতি এবং অতিরিক্ত সমন জারির বিধান বর্ণিত আছে। অর্থাৎ আদালত অথবা ব্যক্তিগতভাবে সমন পাঠানো যাবে। বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি আদালতের মাধ্যমে সমন পাঠাতে চায়, সে ক্ষেত্রে আদালতের রেজিস্ট্রার নির্ধারিত নিবন্ধন বইয়ের ক্রমানুসারে তা প্রেরণ করবেন এবং আদালত কর্তৃক সমন ইস্যুর ১৫ দিনের মধ্যে জারি না হয়ে ফেরত এলে আদালত তার পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮-এর আদেশ-৫ নিয়ম-২০-এর বিধান অনুযায়ী সমন জারি করবে।
আর ব্যক্তিগতভাবে হলে এ আইনের ৭(১) ধারার অতিরিক্ত বিধান হিসেবে বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করলে নিজ খরচে নোটিশ জারি করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে আদালতের জারিকারক কর্তৃক সমন জারিকরণের প্রথমোক্ত অতিরিক্ত ব্যবস্থাটিও কার্যকর হবে। বর্তমানে সমন পাঠানোর জন্য এ আইনের ৭(১) ধারার ক্ষমতাবলে অনেক পত্রিকায় সমন লক্ষ্য করা যায়।
সমন জারির পর, বিবাদীগণ ৯ ধারা অনুসারে ও ১০ ধারায় বর্ণিত সময়সীমার মধ্যে লিখিত জবাব দাখিল করবে এবং মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। বিবাদী লিখিত জবাবের সঙ্গে দালিলিক প্রমাণাদি এবং সেই সঙ্গে একটি হলফনামা দাখিল করতে হবে। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিবাদী লিখিত জবাব প্রদান না করে তাহলে একতরফাভাবে মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১১ ধারা অনুসারে লিখিত জবাবের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জবাব দাখিল করতে পারবে, কিন্তু বিবাদীর অতিরিক্ত জবাব দাখিলের কোনো সুযোগ নেই।
১৩(১) ধারা অনুসারে লিখিত জবাব দাখিলের পর আদালত উভয়পক্ষকে মৌখিক শুনানি শেষে কিংবা তাদের অনুপস্থিতিতে মামলার বিচার্য বিষয় গঠন করবে। আর বিচার্য বিষয় না থাকলে আদালত অবিলম্বে রায় প্রদান করবে। এছাড়াও মামলার শুনানীর জন্য ধার্য কোনো তারিখে যদি বিবাদী আদালতে অনুপস্থিত থাকে অথবা মামলা শুনানীর পর্যায়ে আদালত যদি তাকে প্রয়োজন মতো উপস্থিত না পায় তাহলে এক্ষেত্রে আদালত সে মামলা একতরফা সূত্রে নিষ্পত্তি করতে পারে।
বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তি অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ সালের ৫ম অধ্যায়ে বৈঠক ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিবাদী উপস্থিত হলে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এই আইনের ২২ ধারায়।
উক্ত আইনের ২২ ধারায় বলা আছে যে, মামলায় বিবাদী পক্ষ লিখিত বক্তব্য পেশ করার পর আদালত ধারা ২৪-এর বিধানসাপেক্ষে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে, মামলাটি, নিযুক্ত আইনজীবীগণ কিংবা আইনজীবী নিযুক্ত না হয়ে থাকে তাহলে পক্ষগণের নিকট প্রেরণ করবেন।উক্ত প্রেরিত মামলায় নিযুক্ত আইনজীবীগণ মামলার পক্ষগণের সহিত পরামর্শক্রমে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে অপর একজন আইনজীবী, যিনি কোন পক্ষ কর্তৃক নিয়োজিত নয় অথবা কোন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অথবা অন্য যে কোন উপযুক্ত ব্যক্তিকে মামলা নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নিযুক্ত করতে পারবে; তবে শর্ত থাকে যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি এই ধারার অধীন মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত হবার অযোগ্য হবে। মধ্যস্থতার কার্যক্রম গোপনে অনুষ্ঠিত হবে। মধ্যস্থতার পর মধ্যস্থতাকারী মধ্যস্থতার বিবরণ সম্বলিত একটি রিপোর্ট আদালতে পেশ করতে হবে।
আদালত, যে তারিখে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলার বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদেশ প্রদান করবে, সেই তারিখ থেকে ৬০ (ষাট) দিবসের মধ্যে মধ্যস্থতা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে, যদি না আদালত উভয় পক্ষ কতৃর্ক লিখিত দরখাস্ত দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়, অথবা কারণ উল্লেখপূর্বক স্বীয় উদ্যোগে, উক্ত সময়সীমা অনধিক আরো ৩০ (ত্রিশ) দিবস বর্ধিত করবে।
এ ধরনের কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা বা মধ্যস্থতা হয়ে থাকে তাহলে বিরোধ নিষ্পত্তির শর্তাবলি অন্তর্ভূক্ত করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে এবং মধ্যস্থতাকারী ও আইনজীবীদের তা সত্যায়িত করতে হবে। ঐ সমঝোতা বা মধ্যস্থতার চুক্তির ভিত্তিতে আদালত একটি আদেশ বা ডিক্রী জারী করবেন। এই ধারার অধীন মধ্যস্থতার মাধ্যমে কোন মামলার নিষ্পত্তির আদেশ চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে কোন আপীল বা রিভিশন দায়ের করা যাবে না। এই ধারার অধীন কোন মামলার বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়, তাহলে আদালত কালেক্টরের নিকট হতে আরজির উপর প্রদত্ত সমুদয় কোর্ট ফি ফেরত প্রদানের লক্ষ্যে বাদীর অনুকূলে একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করবে এবং ইহার ভিত্তিতে বাদী প্রদত্ত কোর্ট ফি ফেরত পাবার অধিকারী হবে।
এছাড়াও ৩৮ এবং ৪৪ক ধারাতেও জারির পর্যায়ে এবং আপীল, রিভিশনের যেকোনো পর্যায়ে মধ্যস্থার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধানের সুযোগ রয়েছে।
এই আইনের ৩৮ ধারায় বলা আছে যে, এই আইনের অধীন অর্থ ঋণ আদালত মামলায় প্রদত্ত ডিক্রীর ধারাবাহিকতায় জারী কার্যক্রম অব্যাহত থাকার যে কোন পর্যায়ে পক্ষগণ মধ্যস্থতার মাধ্যমে জারী মামলার বিষয়বস্তু নিষ্পত্তি করে আদালতকে অবহিত করতে পারবে এবং নিষ্পত্তির বিষয়ে আদালত সন্তুষ্ট হলে, আদালত উক্ত জারী মোকদ্দমা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করার আদেশ প্রদান করবে।
এই আইনের ৪৪ক ধারায় বর্নিত আছে যে, আপীল বা রিভিশন কার্যক্রম অব্যাহত থাকার যে কোন পর্যায়ে পক্ষগণ মধ্যস্থতার মাধ্যমে আপীল বা রিভিশন মামলার বিষয়বস্তু নিষ্পত্তি করে আদালতকে অবহিত করতে পারবেন। আদালত উক্ত ধারার অধীন অবহিত হলে এবং নিষ্পত্তির বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে, উক্ত আপীল বা রিভিশন মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করিয়া আদেশ প্রদান করবেন। এই ধারায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মধ্যস্থতার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিবাদীকে সমান সুযোগ দেয়া হয়েছে, যা আইনটিকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছে। পরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান মামলায় যদি নিজের পক্ষে ডিক্রি পায় তাহলে আদালতের আদেশক্রমে বন্ধকি সম্পত্তি ধারা ৩৩ অনুযায়ী নিলামে বিক্রির মাধ্যমে প্রদত্ত ঋণের অর্থ সমন্বয় করতে পারবে বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
আর যদি মধ্যস্থতা কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়াস ব্যর্থ হয় তাহলে আদালত মধ্যস্থতা কার্যক্রমের পূর্ববর্তী অবস্থান হতে মামলার শুনানীর কার্যক্রম আরম্ভ করতে পারবেন।
তবে আদালত মৌখিক যুক্তিতর্ক শুনতে বাধ্য নন। যদি আদালত দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনে এবং সাক্ষ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই করে বা সমাপ্ত হবার দশ দিনের মধ্যে রায় প্রদান করার বিধান রয়েছে এই আইনের ১৬ ধারায়।
এই আইনের ১৬ ধারায় আরো বলা আছে যে, অর্থঋণ আদালতের রায়, আদেশ বা ডিক্রি চূড়ান্ত এবং এই রায়, আদেশ বা ডিক্রির বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। আদালতের আদেশ বা রায়ে ডিক্রিকৃত টাকা ৬০ দিনের মধ্যে যেকোনো একটা সময়সীমা নির্ধারণ করে তার মধ্যে পরিশোধের জন্য বিবাদীকে নির্দেশ প্রদান করবেন। এই আইনের ১৭ ধারায় মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে যা বিবাদী হাজির হলে ৯০ দিন এবং হাজির না হলে ৩০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে যথাযথ কারণ থাকলে ৯০ দিনের সঙ্গে আরও ৩০ দিন যোগ করা যাবে।
একতরফা ডিক্রি প্রদান এবং রদের বিধান বর্ণিত হয়েছে ১৯ ধারায়। ডিক্রি জারির বিধান বর্ণিত হয়েছে ২৬ থেকে ৩৯ ধারায়।
অর্থঋণ মামলার ডিক্রি মূলত টাকা আদায়ের ডিক্রি। তবে এই ডিক্রি জারি সংক্রান্ত নিলাম, গ্রেফতার ও দেওয়ানি আটক ইত্যাদি বিষয়ে কিছু বিধানাবলি সংযোজন করা হয়েছে। ডিক্রি জারি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ এবং দেওয়ানি কার্যবিধির মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলে অর্থঋণ আদালত আইনই প্রাধান্য পাবে। অর্থঋণ আদালতে বিবাদীর বিরুদ্ধে ডিক্রি হয় টাকা আদায়ের জন্য এবং বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম বিক্রয়ের জন্য।
বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম বিক্রির ডিক্রি জারি করা যাবে বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম বিক্রির মাধ্যমে এবং টাকার ডিক্রি জারি করা যায় দায়িককে দেওয়ানি কয়েদে আটক রাখার মাধ্যমে অথবা তার সম্পত্তি ক্রোক ও নিলাম বিক্রির মাধ্যমে বা উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে। জারি মামলায় তৃতীয় পক্ষ দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের বিধান মতে দাবি সম্বলিত আবেদন পেশ করলে ৩২(২) ধারা অনুসারে ডিক্রির অনাদায়ী অংশের ১০% জমা প্রদান করলে ৩২ ধারার বিধান মতে আদালত বিবেচনা করলে এই আবেদন মিস মামলা হিসেবে রেজিস্ট্রিভুক্ত হবে।
অর্থঋণ আদালতের রায়, আদেশ বা ডিক্রি সকল বিবাদিগণের বিরুদ্ধে যৌথ ও পৃথকভাবে কার্যকর হবে। ডিক্রি জারির মামলা সব বিবাদি-দায়িকের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে পরিচালিত হবে। কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। ডিক্রি জারির মাধ্যমে দাবি আদায় হওয়ার ক্ষেত্রে আদালত প্রথমে মূল ঋণ গ্রহীতার সম্পত্তি যতদূর সম্ভব আকৃষ্ট করবেন। মূল ঋণ গ্রহীতার সম্পত্তির পরও যদি দাবি আদায় না করা যায় তাহলে তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা ও তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টরের সম্পত্তি যতদূর সম্ভব আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা ও তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর যদি দাবি পরিশোধ করে তাহলে ডিক্রি তাদের অনুকূলে স্থানান্তরিত হবে এবং তারা মূল ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে তা প্রয়োগ করতে পারবেন।
আপীল, রিভিশন এবং অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ এই আইনের ৪১, ৪২ এবং ৪৩ ধারায় যথাক্রমে আপিল ও রিভিশনের বিধানাবলি বর্ণিত আছে।
আপীল এই আইনের ধারা-৪১ অধীনে ডিক্রীকৃত টাকার পরিমাণ ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ টাকা অপেক্ষা অধিক হয়, তাহলে হাইকোর্ট বিভাগে, এবং যদি ডিক্রীকৃত টাকার পরিমাণ ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ টাকা অথবা তদ্অপেক্ষা কম হয়, তাহলে জেলাজজ আদালতে আপীল দায়ের করতে হবে। আপীলকারী, ডিক্রীকৃত টাকার পরিমাণের ৫০% এর সমপরিমাণ টাকা আদালতে জমা করে আপীল দায়ের করতে হবে। তবে বিবাদী-দায়িক ইতিমধ্যে ১৯(৩) ধারার বিধান মতে ১০% (দশ শতাংশ) পরিমাণ টাকা নগদ অথবা জামানত হিসাবে জমা করে থাকলে, অত্র ধারার অধীনে আপীল দায়েরের ক্ষেত্রে উক্ত ১০% (দশ শতাংশ) টাকা উপরি-উল্লিখিত ৫০% (পঞ্চাশ শতাংশ) টাকা হতে বাদ যাবে৷
তবে এক্ষেত্রে বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই ধারার অধীনে কোন আপীল দায়ের করলে, তাকে উপরি-উল্লিখিত নিয়মে কোন টাকা বা জামানত জমা দান করতে হবে না৷
আপীল নিষ্পত্তির সময়সীমা আপীল আদালত, আপীল গৃহীত হবার পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে এবং ৯০ (নব্বই) দিবসের মধ্যে আপীলটি নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে, আদালত, লিখিতভাবে কারণ উল্লেখপূর্বক, উক্ত সময়সীমা অনধিক আরো ৩০ (ত্রিশ) দিবস বর্ধিত করতে পারবে৷
রিভিশন এই আইনের ধারা-৪২ অধীনে কোন আদালত, আপীলে প্রদত্ত রায় বা ডিক্রীর বিরুদ্ধে কোন রিভিশনের দরখাস্ত গ্রহণ করা যাবে না, যদি না দরখাস্তকারী, আপীল আদালত কর্তৃক প্রদত্ত বা বহালকৃত ডিক্রীর টাকার ৭৫% এর সমপরিমাণ টাকা, আপীল দায়ের কালে দাখিলকৃত ৫০% টাকাসমেত, উক্ত পরিমাণ টাকার স্বীকৃতি স্বরূপে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, অথবা বাদীর দাবী স্বীকার না করলে জামানত স্বরূপে ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার বা নগদায়নযোগ্য অন্য কোন বিনিমেয় দলিল (Negotiable Instrument) আকারে ডিক্রী প্রদানকারী আদালতে জমা করে উক্তরূপ জমার প্রমাণ দরখাস্তের সহিত আদালতে দাখিল করে৷
তবে বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে এই ধারার অধীনে রিভিশন দায়ের করলে, তাকে উপরি-উল্লিখিত নিয়মে কোন টাকা বা জামানত জমা বা দাখিল করতে হবে না৷
রিভিশন নিষ্পত্তির সময়সীমা উচ্চতর আদালত, রিভিশনের দরখাস্ত গৃহীত হবার পরবর্তী ৬০ (ষাট) দিবসের মধ্যে ইহা নিষ্পত্তি করবে, এবং ৬০ (ষাট) দিবসের মধ্যে রিভিশন নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে, আদালত, লিখিতভাবে কারণ উল্লেখপূর্বক, উক্ত সময়সীমা অনধিক আরো ৩০ (ত্রিশ) দিবস বর্ধিত করতে পারবে।
সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে আপীল এই আইনের ৪৩ ধারার অধীনে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক আপীল বা রিভিশনে প্রদত্ত কোন রায়, ডিক্রী বা আদেশের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে আপীল দায়েরের জন্য ঋণ গ্রহীতা-বিবাদীকে আপীল বিভাগ অনুমতি প্রদান করার ক্ষেত্রে, সংগত মনে করলে, এই আইনের ৪২(১) ধারার অনুরূপ পদ্ধতিতে ডিক্রীকৃত টাকার অপরিশোধিত অবশিষ্টাংশের যে কোন পরিমাণ টাকা নগদ বাদী-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অথবা জামানতস্বরূপ ডিক্রী প্রদানকারী আদালতে জমাদান করার আদেশ প্রদান করবে।
অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধ রীট মামলা অর্থঋণ আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না, সে ক্ষেত্রে রিট মামলা দায়ের করা যাবে।
দিবস গণনার ক্ষেত্রে এই আইনের ৪৮ ধারার অধীনে দিবস গণনার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বিচারকের কার্যদিবস গণনা করা হইবে এবং সাময়িকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকের কার্য দিবসও অনুরূপ গণনার অন্তর্ভুক্ত হইবে৷