উইকিশৈশব:এটা কীভাবে কাজ করে/রকেট
একটি রকেট এমন একটি যান যেটি দ্রুত চলমান তরল বা গ্যাস দ্বারা চালিত হয়। যে রকেটগুলিতে কিছু নির্দেশাবলী দেওয়া থাকে, যার সাহায্যে তারা উড়ানের সময় তাদের গতিপথ সংশোধন করতে পারে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র বলা হয়।
কে এটি আবিষ্কার করেছে?
সম্পাদনাসুং রাজবংশের শাসনকালে (৯৬০ - ১২৭৯), চীনারা প্রাথমিক ধরনের রকেট আবিষ্কার করেছিল, যেটি হল আতশবাজি। কিংবদন্তি অনুসারে একজন বাবুর্চি আবিষ্কার করেছিলেন যে সালফার, সল্টপিটার বা পটাসিয়াম নাইট্রেট এবং চারকোলের (বারুদ) একটি নিখুঁত মিশ্রণ অত্যন্ত দাহ্য এবং এই মিশ্রণকে যদি একটি ছোট জায়গায় আবদ্ধ করা হয়, তাহলে আগুন দিলে বিস্ফোরিত হবে; এই কারণেই আতশবাজি তৈরির সময় বারুদকে নলের মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়। চীনারা এরপরেই আবিষ্কার করেছিল যে এই কালো চূর্ণটি প্রচণ্ড গতিতে আকাশে উঠতে পারে। এটিকেই রকেট প্রযুক্তির সূচনা বলা যায়। দক্ষ ব্যবসায়ীরা বারুদ তৈরি করে তার বাণিজ্যিকীকরণ করেছিলেন এবং তারা বিনোদনের জন্য আতশবাজিও তৈরি করেছিলেন।
যদিও চীনারা প্রথম রকেট আবিষ্কার করেছিল, বর্তমানে ব্যবহৃত শক্তিশালী রকেটগুলি এসেছে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ থেকে। রবার্ট গডার্ড তরল জ্বালানীর সাহায্যে চালানো একটি রকেট প্রদর্শন করেছিলেন। তার তৈরি রকেট অনেকখানি উচ্চতায় পৌঁছোতে সক্ষম হয়েছিল। এর পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে রাশিয়ান এবং জার্মান বিজ্ঞানীরা রকেট অস্ত্র তৈরি করে তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন।
এটি কিভাবে ক্ষমতা পায়?
সম্পাদনাসাধারণত রকেটের মধ্যেই থাকা রাসায়নিক বিক্রিয়া বা বিস্ফোরণ দ্বারা একটি রকেট চালিত হয়। রকেট বিভিন্ন ধরণের জ্বালানী দ্বারা চালিত হতে পারে: প্রথম দিকের চীনা রকেটগুলিতে বারুদ ব্যবহার করা হত, পরে লোকেরা রকেটের জ্বালানিতে পেট্রোল এবং অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য ব্যবহার করত। বিস্ফোরণ এড়াতে প্রায়ই রকেটের জ্বালানি হিমায়িত অবস্থায় রাখতে হতো। কিছু রকেটে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনকে একত্রিত করে তীব্র রাসায়নিক বিক্রিয়া তৈরি করা হয়। কিছু রকেটে, যেমন রাশিয়ান এন১, কেরোসিন ব্যবহার করা হয়। স্যাটার্ন ফাইভ রকেটের ৩টি পর্যায় ছিল এবং এতে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি (প্রথম পর্যায়ে) এবং হাইড্রোজেন জ্বালানি (দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ে) দুটিই ব্যবহৃত হয়েছে।
এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটটিই ছিল স্যাটার্ন ফাইভ, এটি ব্যবহার করা হয়েছিল একজন মানুষকে চাঁদে পাঠানোর জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিন হল স্পেস শাটলের রকেট বুস্টার। (স্যাটার্ন ফাইভ আরও শক্তিশালী ছিল কারণ এটিতে পাঁচটি ইঞ্জিন ব্যবহার হয়েছিল, যেখানে শাটলের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল দুটি।) শাটল বুস্টারগুলি মূলত অ্যালুমিনিয়াম এবং অ্যামোনিয়াম পারক্লোরেটের মত কঠিন জ্বালানী মিশ্রণ দ্বারা জ্বালানো হয়।
এটি কতটা বিপজ্জনক?
সম্পাদনারকেটকে চালানোই হয় একটি বিশাল নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, এটি খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। এগুলি খুবই বিপজ্জনক বলে, রকেট নিয়ে কাজ করার সময় নিরাপত্তা একটি প্রধান মনোযোগের বিষয়। সাবধানতা সত্ত্বেও, দুর্ঘটনা ঘটেছে, এবং একজন নভোচারী হওয়া খুবই বিপজ্জনক একটি কাজ। কক্ষপথে পেলোড স্থাপন করতে বা মহাকাশ স্টেশন পরিদর্শন করতে ব্যবহৃত রকেটগুলিও জ্বালানী বহন করে। তাই খুব সতর্কতার সাথে ব্যবহার না করলে একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
সামরিক বাহিনী রকেটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এই ধরনের রকেটগুলিকে উৎক্ষেপণের স্থান থেকে দূরে কোন এলাকায় বিস্ফোরক ফেলার জন্য নকশা করা হয়েছে। রকেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং মারাত্মক অস্ত্রগুলি ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে নিক্ষিপ্ত হয়।
এমনকি ছোট শখের রকেটগুলি যেগুলি শিশুদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হয়, যদি সেগুলি সঠিকভাবে পরিচালনা না করা হয় তবে খারাপভাবে পুড়ে যেতে পারে। কখনো কোনো ব্যক্তি বা প্রাণীর দিকে লক্ষ্য করে রকেট জ্বালাবে না। শিশুরা যেন কখনোই একা রকেট না জ্বালায়, সবসময় প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে নিয়ে রকেট উৎক্ষেপণ করা উচিত।
এটি কিভাবে পরিবর্তিত হয়?
সম্পাদনাকিছু রকেট থাকে বিশাল; কিছু হয় ছোট্ট। কিছু রকেট ৩৩৩ মেট্রিক টন বোঝা বহন করতে পারে, (যার মধ্যে ৩০৫ জ্বালানী), অন্যদের ওজন মাত্র কয়েক গ্রাম। ছোট মডেলের কিছু রকেট রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি তো মাত্র কয়েক ইঞ্চি লম্বা। বিশাল রকেটও রয়েছে, যাদের উচ্চতা ২০০ ফুটেরও বেশি, সেগুলি মহাকাশ কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হয়।
তাদের আকারও বিভিন্ন রকমের হয়। বেশিরভাগ রকেটের আকার হল হল চোঙের মত, যার ডগার আকৃতি শঙ্কুর মত এবং রকেটের গোড়ায় পাখনার মত নির্মান থাকে। আতশবাজির জন্য ব্যবহৃত রকেটগুলি প্রায়শই গোলাকার হয় এবং সেগুলি চোঙের আকারের নল থেকে নিক্ষেপ করা হয়।
আরেকটি পার্থক্যের জায়গা হল তারা কোন ধরনের অভিঘাত ব্যবহার করে। বেশিরভাগই উচ্চ চাপযুক্ত গ্যাস ব্যবহার করে। যখন এই গ্যাস মুক্ত হয়, এটি রকেটের অগ্রভাগ থেকে বেরিয়ে আসে, যেমন একটি ফোলানো বেলুনের মুখ খুলে দিলে তার মধ্যে থেকে বাতাস বেরিয়ে আসে। আতশবাজির রকেটকে আকাশে পাঠানোর জন্য বারুদ ব্যবহার করা হয়।
আরও একটি বৈচিত্র্য হল কিরকম ভূদৃশ্যের ওপর দিয়ে রকেট উড়ে যায়। কেউ কেউ ভূমি ও জলের ওপরে নিচ দিয়ে উড়ে যায় এবং খুব উচ্চ গতিতে পৌঁছতে সক্ষম। অন্যরা, যেমন স্যাটার্ন ফাইভ, মহাকাশে উড়ে যায়, অর্থাৎ অনেক উঁচুতে। কিছু কিছু রকেট জলের নিচে 'উড়তে' পারে।
কিভাবে এটি বিশ্বের পরিবর্তন করেছে?
সম্পাদনাহাজার হাজার মাইল দূরে থাকা কাউকে তুমি যখন ডাকো, একটি উপগ্রহ তোমাকে এ কাজে সাহায্য করে। মহাকাশের কক্ষপথে স্থিত উপগ্রহটি কলটি পায় এবং তারপর প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে এটিকে পৃথিবীতে যথাযোগ্য স্থানে প্রতিফলিত করে। উপগ্রহটি রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে দূরবীক্ষণ যন্ত্র (টেলিস্কোপ) ব্যবহার করেন কারণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আমাদের কিছু আলো এবং পর্যবেক্ষণকে বিকৃত করে। মহাকাশে একটি উপগ্রহ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করতে ১০০ ফুটেরও বেশি উঁচু একটি বিশাল রকেট লাগে।
রকেট মহাকাশচারীদের মহাকাশে নিয়ে যায়। মহাকাশচারীদের পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের কারণে আমরা এখন পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি জানতে পেরেছি। মহাকাশচারীরা মহাকাশে স্ফটিক বিকশিত করেছেন এবং সেখানে কাজ করেছেন। মহাকাশে ব্যবহৃত উদ্ভাবনগুলি এখন মানুষের দখলে রয়েছে এবং এই অনেক উদ্ভাবন আমাদেরকে নতুন প্রযুক্তি প্রদান করে, যেমন অগ্নি নিরোধক পোশাক বা শব্দ কম্পক (ভাইব্রেটর) যা চক্ষুহীনদের মুদ্রণ পড়তে সাহায্য করে।
রকেট বিশ্বকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে এবং মহাবিশ্বকে দেখার জন্য আমাদের নতুন চোখ দিয়েছে।
এটি তৈরি করার আগে কী ধারণা এবং উদ্ভাবন তৈরি করতে হয়েছিল?
সম্পাদনারকেটে ব্যবহৃত শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াকে যাতে সামলানো যায় সেইজন্য একটি শক্তিশালী ধাতব ভিত্তি তৈরি করতে হয়েছিল। এবং তারপরে, শক্ত জ্বালানী তৈরি করতে হয়েছিল যাতে কোন ছিদ্র থাকলে তরল জ্বালানী পড়ে বিপর্যয় ঘটাতে না পারে। প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বিজ্ঞানীদের একটি কাঠামোর নকশা করতে হয়েছিল। এছাড়া জ্বালানীর কথা না বললে হবে না, কিছু করার আগে সত্যিই জ্বালানী তৈরি করতে হয়েছিল!
রকেট প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ
সম্পাদনারকেট প্রযুক্তি নানা দিক দিয়ে আমাদের জীবনকে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত করেছে এবং এটি চিরকাল চলতে থাকবে। সুং রাজবংশের (৯৬০ - ১২৭৯) শাসনকালে এটির আবিষ্কারের পর থেকে এটি মানুষের ভালোই করেছে। মানুষ এখন মহাকাশ সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি জানে।
রকেটের জন্য নতুন প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিদিন আলোচনা হচ্ছে এবং রকেটকে পারমাণবিক শক্তি দিয়ে চালিত করার পরিকল্পনা বিবেচনা করা হচ্ছে। পারমাণবিক শক্তি সাশ্রয়ী এবং শক্তিশালী, এটি অভিঘাত প্রদানকারী কম খরচের জ্বালানীকে সংগঠিত করে। রকেট আমাদের চাঁদে নিয়ে গেছে এবং অবশ্যই আমাদের আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা এমন রকেট ব্যবহার করার প্রস্তাব দিচ্ছেন যা আমাদেরকে মহাকাশে নিয়ে যাবে এবং ফেরত নিয়ে আসে। এগুলি পুনঃব্যবহারযোগ্য হবে, যার অর্থ এই রকেটগুলি পৃথিবীতে আসার পর তাদের জ্বালানি ভরে দেওয়া হবে যাতে আমরা একই রকেট দিয়ে আবার মহাকাশে ফিরে যেতে পারি। এটি একটি ভাল পরিকল্পনা হবে কারণ এর ফলে আমরা প্রচুর অর্থ বাঁচাতে পারব এবং আমরা ভবিষ্যতে মহাকাশে ভ্রমণের জন্য এই অর্থ ব্যবহার করতে পারব।
সম্প্রতি, রকেটের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে শাটল, কারণ সেগুলি রকেট বুস্টারগুলিতে অনেক মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করে। যাইহোক, বিজ্ঞানীরা এখন পৃথিবীর মঙ্গল উপনিবেশে সরবরাহ করার মত রকেটের নকশা করছেন। সম্ভবত সেটি রকেটের জন্য একটি নতুন জীবন হবে?
কিছু বিজ্ঞানী উল্লেখ করেছেন যে রকেটগুলি ভবিষ্যতে শুধুমাত্র বুস্টার এবং সমন্বয় অভিঘাতক হিসাবে কাজ করতে পারে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনাHow Stuff WORKS :Rocket Science [১]
NASA - Launch Vehicle Summary [২]
How Things Work :A History of Pyrotechnics