দোয়েল দেখতে সুন্দর, ছোটো ও আদুরে। পুরুষ দোয়েলের বেশিরভাগ অংশই কালো, তবে ডানা বরাবর একটি অংশ ও পেট সাদা। নারী দোয়েলের উপরিভাগ ও গলার নিচ ছাই-রঙা হয়। দোয়েল বাংলাদেশের জাতীয় পাখি। বাংলার গ্রামে ও শহরে সর্বত্রই এদের বসবাস। দোয়েলের গান খুব মিষ্টি হয়।

দোয়েল

এছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতে জনবসতির আশেপাশে দেখতে পাওয়া অনেক ছোট পাখিদের মধ্যে দোয়েল অন্যতম। সদা চঞ্চল এই পাখিটি সর্বদা গাছের ডালে বা মাটিতে লাফিয়ে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। গ্রামীণ অঞ্চলে খুব ভোরে তাদের কলকাকলি শোনা যায়। দোয়েল গ্রামের সৌন্দর্য আরও অপরূপ করে তোলে, আর শহরে দেয় কিছুটা প্রকৃতির সাথে সান্নিধ্যের স্বাদ।

বাসস্থান

সম্পাদনা

দক্ষিণ এশিয়ায় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে, মূলত: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও ফিলিপাইনে এদের পাওয়া যায়। সাধারণত কাঠসমৃদ্ধ বন, চাষাবাদকৃত জমির আশেপাশে ও জনবসতিতে মানুষের কাছাকাছি এদের দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে মূলত গ্রামীণ অঞ্চলে এদেরকে বেশি দেখা যায়।

দোয়েল আকারে ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা। এর লম্বা লেজ আছে যা অধিকাংশ সময় খাড়া করে রাখে। নারী দোয়েলের পেটের অংশ পুরুষ-দোয়েলের মত উজ্জ্বল নয়, বরং কিছুটা ফিকে সাদা। কিন্তু দেখতে অপরূপ সুন্দর।

 
নারী দোয়েল

ডিম পাড়া

সম্পাদনা

দক্ষিণ এশিয়ায় স্ত্রী দোয়েলরা মার্চ থেকে জুলাই মাসে ডিম পাড়ে; আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসে। ডিম দেয়ার এক সপ্তাহ আগে এরা গাছের কোটরে বা ছাদের কার্ণিশে বাসা বানায়। সাধারণত ৪/৫টি ডিম দেয়। ডিমের রং ফিকে নীলচে-সবুজ, তার উপর বাদামী ছোপ থাকে। স্ত্রী দোয়েল ডিমে তা দেয়; ৮ থেকে ১৪ দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

স্বভাব-প্রকৃতি

সম্পাদনা

নানা রকম সুরে ডাকাডাকির জন্য দোয়েল সুপরিচিত। অস্থির এই পাখীরা সর্বদা গাছের ডালে বা মাটিতে লাফিয়ে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। কীট পতঙ্গ, ছোট ছোট শুঁও পোকা এদের প্রধান খাদ্য। কখনো কখনো সন্ধ্যার আগে আগে এরা খাবারের খোঁজে বের হয়। পুরুষ দোয়েল স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য মিষ্টি সুরে ডাকাডাকি করে। তবে স্ত্রী দোয়েলও পুরুষ দোয়েলের উপস্থিতিতে ডাকতে পারে।

প্রয়োজন না হলে দোয়েল এক নাগাড়ে বেশি দূর উড়ে না। মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্য খোঁজে। ধান কিংবা ভাত খাবার জন্য এ পাখি গৃহস্থের গোলাঘর, কিংবা রান্না ঘরেও ঢুকে পড়ে। শীতের সময় দোয়েল পাখি দেখা যায় না বললেই চলে এর কারন হচ্ছে এরা শীতের সময় গান গায় না যার কারনে এই সময় এরা আমাদের নজরে পড়ে না[]

সাংস্কৃতিক তাৎপর্য

সম্পাদনা

বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে দেশী ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দোয়েল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের লেখাতে এই পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মুদ্রাতে (দুই টাকা) এই পাখির ছবি বহুল ব্যবহৃত। এই পাখির নামে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে দোয়েল চত্বর নামে একটি সড়ক চত্বর আছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার মাঝে অবস্থিত।[]

 
দোয়েল চত্বর

লোকগাথা

সম্পাদনা

দোয়েল নিয়ে বাংলাদেশের যশোরে প্রচলিত একটি গল্প আছে- এক দেশে কুচকুচে কালো এক দধিয়াল বাস করত। তার মতো সাদা দই আর কেউ বানাতে পারত না। তার দই পেলে মানুষ অন্য কারো দই খেত না। অন্য গয়ালরা চেয়েছিল এ দধিয়ালের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দই তৈরির কায়দাটা শিখে নিতে। কিন্তু দধিয়াল বিয়ে করেনি। দেশটির বুড়ো রাজা একদিন অল্প বয়েসী এক সুন্দরীকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু মন্ত্রী চালাকি করে বললেন- মা যশোরেশ্বরী তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, কন্যাটিকে স্পর্শ করলে রাজার অমঙ্গল হবে। তাই রাজা ওই সুন্দরীকে বিয়ে করে অন্য এক পুরীতে বন্দি করে রাখলেন। নতুন রানি দই ছাড়া ভাত খাবেন না। মন্ত্রী রাজাকে ওই দধিয়ালের কথা জানালেন। লোকটি কালো হওয়ায় রাজা সন্দেহ না করে রাজি হলেন। দধিয়াল রানিকে রোজ দই দিতেন। তার জাদুকরি দই খেয়ে রানি অমৃতের স্বাদ পেলেন। তাদের মধ্যে প্রেম হল। একদিন এ খবর রাজা জেনে গেলে রানির কাছে দধিয়ালের যাওয়া বন্ধ করে দেন। অনেকদিন পর একরাতে দধিয়াল দুটি কালো হাঁড়িতে দই নিয়ে রানির পুরীর সামনে এসে ব্যাকুলভাবে ডাকতে লাগলেন। রানি তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলেন না। তিনি যশোরেশ্বরীর কাছে প্রার্থনা করলেন। অতঃপর একটি পাখি হয়ে পিক করে ডেকে গাছে গিয়ে বসলেন। দধিয়ালও তখন পাখি হয়ে তার পাশে গিয়ে বসলেন। এরপর দু’জনেই উড়ে অন্য রাজ্যে চলে গেলেন। এরাই দোয়েল, দধিয়াল বা দয়েল পাখি। সেই দইয়ের সাদা আর হাঁড়ির কালো রং এখনও দোয়েলের বুকে দেখা যায়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েলের পরিচিতি, বৈশিষ্ট, স্বাভাব, প্রজননকালীন আচরণ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব"অনুবাদ(প্রাণীর সাথে পরিচয়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০৬ 
  2. "দোয়েল চত্বরের তিলোত্তমায় মুগ্ধ পথচারী"। ঢাকা। মে ৭, ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১১, ২০২১