উইকিশৈশব:বাদ্যযন্ত্র/পাখোয়াজ
পাখোয়াজ ভারতীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত একপ্রকার পিপা আকৃতির, দুই মাথার ড্রাম। মৃদঙ্গের মতো এটিও চামড়ার তাল রক্ষাকারী বাদ্যযন্ত্র। এটি একটি শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্র। পাখোয়াজের দুইটি মুখ আছে। এর একটি মুখ অন্যটির তুলনায় সামান্য বড়। কোলের ওপরে নিয়ে বামহাতে বড় দিক ও ডানহাতে ছোটো দিকটি বাজানো হয়। এটি গুরুগম্ভীর শব্দ সৃষ্টি করে। এখন পখোয়াজের দেহ কাঠামো তৈরি হয় কাঠ দিয়ে কিন্তু ঐতিহ্য অনুসারে কেউ কেউ একে মৃদঙ্গের শ্রেণিভুক্ত করে থাকেন ও পুরোনো মৃদঙ্গমের বংশধর বলে থাকেন।[১] বাদ্যযন্ত্রটি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে উদ্ভূত।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সম্পাদনাসংস্কৃত ভাষায় পাখোয়াজ এর নাম পক্ষাতোদ্য। যা প্রাকৃত পকখাউজ্জ হয়ে বাংলায় পাখোয়াজ হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় প্রাচীনকালে ভারতীয়রা পাখোয়াজ ব্যবহার করতো। প্রাচীন ভারতে পাখোয়াজের কাঠামো তৈরি হতো মাটির খোল পুড়িয়ে।[২]।
বঙ্গদেশে পাখোয়াজ
সম্পাদনাখ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে বঙ্গদেশে কিছু পাখোয়াজ বাদকের নাম পাওয়া যায়। তবে এনাদের দ্বারা কোনো বিশেষ বাদনরীতি প্রচলিত হয় ছিল না। তাছাড়া পরম্পরাগত কোনো পাখোয়াজ শিল্পীরও উল্লেখ পাওয়া যায় না। প্রথমদিকে পাখোয়াজের চর্চা শুরু হয়েছিল কৃষ্ণনগর, বিষ্ণুপুর, চন্দ্রকোণা, বহরমপুর প্রভৃতি অঞ্চলে। সে সময় ধ্রুপদ গানের বেশ কদর ছিল এই অঞ্চলে মূলত বিষ্ণুপুর ঘরাণার কারণে। এই সূত্রে এই অঞ্চলগুলোতে ধ্রুপদ তালরক্ষাকারী যন্ত্র হিসেবে পাখোয়াজ বাদন চালু হয়েছিল। তবে যথাযথ তথ্য না থাকায়, এই সময়ের পাখোয়াজ বাদনের ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যে জনৈক 'সমজ খেল' নামক মৃদঙ্গবাদকের নাম পাওয়া যায়। সে সময়ের কালোয়াতি গান বলতে ধ্রুপদকেই বুঝানো হতো। এই গানের সাথে মৃদঙ্গবাদক 'সমজ খেল' পাখোয়াজ বাজাতেন বলেই অনুমান করা যায়।
কালোয়াত গায়ন বিশ্রাম খাঁ প্রভৃতি।
মৃদঙ্গী সমজ খেল কিন্নর আকৃতি॥
ধারণা করা হয়, কৃষ্ণনগরের পরে কালোয়াতি গানের চর্চা শুরু হয় বিষ্ণুপুরে। যতদূর জানা যায়, বিষ্ণুপুরের প্রথম বাঙালি পাখোয়াজ বাদক ছিলেন বেচারাম চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিষ্ণুপুরী ঘরাণার ধ্রুপদের প্রতিষ্ঠাতা পণ্ডিত রামশঙ্কর এবং তার তৃতীয় পুত্র রামকেশরের (জন্ম আনুমানিক ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দ) সাথে পাখোয়াজ সঙ্গত করেছেন। উল্লেখ্য, এঁর ভ্রাতুষ্পুত্র গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নাটোরের মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ রায়ের (১৮৬৮-১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ) সঙ্গীত সভার বৃত্তিধারী পাখোয়াজবাদক ছিলেন। রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বিষ্ণুপুর নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বেচারাম বিখ্যাত মৃদঙ্গবিদ লালা হীরালালজীর কাছে মৃদঙ্গবাদন শিখেছিলেন। সম্ভবত হীরালালজী ছিলেন অবাঙালি। বেচারাম চট্টোপাধ্য এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া, তার বংশের বা শিষ্যের ভিতর আর কোনো পাখোয়াজ বাদকের নাম পাওয়া যায় না।
বিষ্ণুপুরের অপর প্রখ্যাত পাখোয়াজ ছিলেন রামমোহন চক্রবর্তী। এঁর দ্বারা একটি পাখোয়াজ বাদন গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তিনি পাখোয়াজবাদন শিখেছিলেন পীরবক্সের কাছে। রামমোহনের শিষ্য ছিলেন জগৎ গোস্বামী। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ গায়ক যদুভট্ট বিষ্ণুপুরে থাকার সময়, জগৎশেঠ তার সাথে সঙ্গত করতেন। রামমোহনের অপর শিষ্য জগন্নাথ মুখোপাধ্যায় ১৮৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ত্রিপুরার রাজ দরবারে যদুভট্টের সাথে সঙ্গত করেছেন। রামমোহনের অপর শিষ্য অনন্তলাল মুখাপাধ্যায় পাখোয়াজবাদক হিসেবে কলিকাতায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সেকালের প্রখ্যাত ধ্রুপদ গায়ক শিবনারায়ণ মিশ্র, কান্তাপ্রসাদ মিশ্র, গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, যদুভট্টের সাথে সঙ্গত করেছেন। এই তিন শিষ্যের সূত্রে রামমোহন চক্রবর্তীকে বিষ্ণুপুরী ঘরানার পাখোয়াজ বাদনের স্থপতি বলা হয়।
আকার ও গঠন
সম্পাদনাএকটি আদর্শ পাখোয়াজ প্রায় ৬০ সেমি দৈর্ঘ্য এবং ২০-২৫ সেন্টিমিটার কাঠের নলাকার খোল এর দেহগত কাঠামো। এর মধ্যভাগ সামান্য স্ফীত। এর উভয় প্রান্তের খোলা মুখ চামড়া দ্বারা আবদ্ধ থাকে। এর ডান দিকের মুখটি বাম পাশ মুখ অপেক্ষা ছোটো হয়। এই অংশটি অনেকটা তবলার মতো। ডান দিকের মুখটির ব্যাস হয় সাধারণত ১৫-১৭ সেমি হয়। বাম দিকের অংশের ব্যাস সাধারণত ২০-২৩ সেমি হয়ে থাকে।[৩]
এর উভয় মুখের চামড়া আচ্ছাদনকে বলা হয়, ছাউনি বা পুড়ি। ডান দিকের অংশে চামড়ার মধ্যভাগে গোল করে উপরে গাব বা স্যাহী যুক্ত করা হয়। বাম দিকের অংশে গাব বা স্যাহী থাকে না।
প্রয়োগ
সম্পাদনামূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পাখোয়াজ ব্যবহার হলেও ধ্রুপদী গানের সকল তালই এই যন্ত্রের মাধ্যমে বাজানো যায়। পাখোয়াজ বাদককে সাধারণভাবে বসে যন্ত্রটি সামনে অনুভূমিক অবস্থানে রেখে উভয় হাতের সাহায্যে বোল তুলতে হয়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ বঙ্গীয় শব্দকোষ (দ্বিতীয় খণ্ড)। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০১। সাহিত্য আকাদেমী।
- ↑ "Shadjamadhyam"। ১৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। বৈশাখ ১৩৭২। কথাশিল্প প্রকাশ।