উইকিশৈশব:মানবদেহ/পাচনতন্ত্র
আমাদের দেহের বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধির জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। পাচন হল একটি পদ্ধতি, তার প্রথম ভাগে আছে আমরা যে খাদ্য ও পানীয় খাই তা শরীরে গ্রহণ করা এবং এরপরের ধাপ হল সেটি শরীরের সমস্ত অংশে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা। পাচনতন্ত্র খাদ্যকে তার জটিল অবস্থা থেকে সরল অবস্থায় ভেঙ্গে দেয় এবং শরীরের সব অংশে বহন করে নিয়ে যায়।
পাচনতন্ত্র কেমন দেখতে?
সম্পাদনাপাচনতন্ত্র দেখতে অনেকটা লম্বা নলের মত, যার সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গ সংযুক্ত হয়ে আছে। এটি প্রায় ১০ মিটার মত লম্বা। এই তন্ত্রের শুরু হয় মুখ থেকে। এর পরে আছে খাদ্যনালী বা ইসোফেগাস, যেটি একটি দীর্ঘ নল যা মুখকে পাকস্থলীর সাথে সংযুক্ত করে, এই অংশটি পাঁজরের খাঁচার মধ্যে থাকে। পাকস্থলী একটি থলির মত কাঠামো যার আকার ইংরেজির 'জে' অক্ষরের মত। এই পাকস্থলী প্রচুর পেশী দিয়ে গঠিত এবং এটি পাঁজরের খাঁচার নিচে অবস্থিত।
পাকস্থলী সংযুক্ত হয়েছে ক্ষুদ্রান্ত্রের সাথে। এটি একটি লম্বা সরু নল। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ মিটার। এটি পেটের গহ্বরের মধ্যে সামনের দিকে এবং পিছনের দিকে কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। এটি সংযুক্ত হয়েছে বৃহদন্ত্রের সাথে। বৃদন্ত্রের ব্যাস ক্ষুদ্রান্ত্রের থেকে বেশি কিন্তু এটি দৈর্ঘ্যে অনেক ছোট। বৃহদন্ত্রের শেষ অংশের নাম মলাধার বা পায়ু এবং এটি পায়ুছিদ্র বা মলদ্বারে গিয়ে শেষ হয়।
যকৃৎ বা লিভার এবং অগ্ন্যাশয় হল দুটি গ্রন্থি বা গ্ল্যাণ্ড। এরা একধরণের তরল তৈরি করে নিঃসরণ করে যেটি খাদ্য হজমে আমাদের সাহায্য করে – এটি মুখের মধ্যে তৈরি হওয়া লালারসের মতই। পুরো এই পাচনতন্ত্রের মধ্যে রয়েছে খাদ্যনালীর সমস্ত নলাকার গঠন, অঙ্গ এবং গ্রন্থি; এর মধ্যেই খাদ পাচিত হয় বা সোজা কথায় হজম হয়।
পাচনতন্ত্রের অংশগুলি কি কি?
সম্পাদনাপাচনতন্ত্রের একদম শুরুতেই আছে মুখ, যেখান দিয়ে খাদ্য এবং জল আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। আমাদের মুখে, আমাদের দাঁত এবং জিহ্বা পাচনের প্রথম কাজটি করে। মুখের মধ্যে প্রথমেই এদের সাহায্যে খাদ্য ছোট ছোট টুকরো করে ভাঙা হয়। মুখের মধ্যে থাকে লালাগ্রন্থি। সেখান থেকে যে লালা নিঃসৃত হয় তাতে থাকে অ্যামাইলেজ বা টাইলিন নামক একপ্রকার উৎসেচক (এনজাইম)। এই উৎসেচক খাবারের শ্বেতসারকে মলটোজে রূপান্তরিত করে যা একটি জটিল শর্করা।
আমরা খাবার চিবিয়ে এবং লালারসের সাথে মিশিয়ে মণ্ড অবস্থায় নিয়ে আসি এবং সেটি গিলে ফেলি। এটি খাদ্যনালী নামক একটি নল দিয়ে নিচে চলে যায়। এই নালী মুখ থেকে গিয়ে সংযুক্ত হয় পাকস্থলীতে। চিবানো খাদ্যকে পাকস্থলীতে পৌঁছোতে সহায়তা করে এই খাদ্যনালীতে থাকা পেশীর পর্যায়ক্রমে সংকোচন ও প্রসারণ, যার নাম পেরিস্টলসিস।
পাকস্থলীতে খাদ্য আরও বেশি ভেঙে যায়। পাকস্থলী থেকে পাচকরস নির্গত হয়, যার মধ্যে থাকে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, পেপসিন এবং শ্লেষ্মা (মিউকাস)। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড খাদ্যকে অম্লীয় করে তোলে, খাদ্যের মধ্যে থাকা জীবাণু হত্যা করে এবং পেপসিনকে সক্রিয় করে তোলে। পেপসিন খাদ্যের প্রোটিন অংশকে পাচিত করে। শ্লেষ্মা পাকস্থলীর দেওয়ালে একটি সুরক্ষামূলক আবরণ সৃষ্টি করে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড এবং পেপসিনের ক্রিয়া থেকে পাকস্থলীর অভ্যন্তরীণ আস্তরণকে রক্ষা করে। এটি হওয়ার পরে, খাবারটি চলে যায় ক্ষুদ্রান্ত্রে।
ক্ষুদ্রান্ত্র হল একটি খুব লম্বা পাকানো নল। এখানেই সবচেয়ে বেশি পাচন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়; এখানে খাদ্য মিশ্রিত হয় ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে নির্গত আন্ত্রিক রসের (সুকাস এন্টারিকাস) সাথে। এছাড়া এখানে এসে পড়ে অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত ট্রিপসিন (যা প্রোটিন হজমে সাহায্য করে), লাইপেজ (যা লিপিড বা স্নেহ পদার্থ হজমে সহায়তা করে) এবং পিত্ত থলিতে জমা হওয়া পিত্ত রস যেটি নিসৃত হয় যকৃৎ থেকে। পিত্ত রস খাবারকে ক্ষারীয় করে তোলে এবং খাদ্যের চর্বিগুলিকে ভেঙ্গে ফেলে।
এই রাসায়নিকগুলি খাদ্যকে ভেঙে সরল করে দেয় যাতে এটি রক্তে শোষিত হতে পারে। ক্ষুদ্রান্ত্রের অভ্যন্তরীণ দেওয়ালে ভিলি (আঙুলের মত গঠন) এবং রক্তনালী থাকে। এগুলি খাদ্য থেকে পুষ্টি শোষণ করে নেয়।
শোষিত হবার পর যা কিছু বাকি থাকে তা চলে যায় বৃহদন্ত্রে। সেখানেও অভ্যন্তরীণ দেওয়ালে ভিলি থাকে, যেগুলি এই অবশিষ্টাংশ থেকে জলীয় অংশ শোষণ করে নেয়। সেখান থেকে, বর্জ্য অবশেষে মলদ্বার দিয়ে শরীরের বাইরে চলে যায়। মলদ্বারের স্ফিংক্টর (একরকম পেশীর নাম) মলত্যাগের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
পাচনতন্ত্রের কাজ কি?
সম্পাদনাপাচনতন্ত্রের কাজ হল আমরা যে খাবার খাই তা গ্রহণ করা এবং আমাদের শরীরের পক্ষে এটি ব্যবহারের উপযোগী করা। পাচনতন্ত্র জটিল খাদ্যকে ভেঙে সরল করে দেয় যাতে আমাদের শরীর এটি শোষণ করে ব্যবহার করতে পারে। এটি খাদ্যের বর্জ্য অংশগুলি, যেগুলি শরীর ব্যবহার করতে পারে না, সেগুলিকে আলাদা করে দেয়। খাদ্যের মধ্যে প্রোটিন, শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট ও স্নেহ পদার্থ বা ফ্যাট এই তিনটি উপাদান থাকে, যেগুলি আলাদাভাবে ভেঙে দেওয়া হয়- প্রোটিন ভাঙে অ্যামিনো অ্যাসিডে, শর্করা ভেঙে হয় গ্লুকোজ এবং স্নেহ পদার্থ ভাঙে ফ্যাটি অ্যাসিড এবং গ্লিসারলে।
পাচনতন্ত্র কিভাবে শরীরের অন্যান্য অংশের সাথে যোগাযোগ করে?
সম্পাদনাশরীরের সব অংশে যাতে পুষ্টি পরিবাহিত হয় সেইজন্য পাচনতন্ত্র আমাদের রক্ত সংবহনতন্ত্রের সাথে কাজ করে। খাবার ভেঙে যাওয়ার পরে ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছে যায়, রক্তনালী তার থেকে পুষ্টি শোষণ করে, তারপর সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরের সমস্ত কোষে পুষ্টি উপাদান পৌঁছে দেয়।
কিভাবে তুমি তোমার পাচনতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে পারো?
সম্পাদনাতোমার পাচনতন্ত্র সুস্থ রাখার একটি বড় অংশ হল স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। চেষ্টা কর খাওয়া যেন খুব বেশি বা খুব কম না হয়। খুব ভালভাবে চিবিয়ে খাবার খাওয়া অভ্যাস করো। খাদ্যের মধ্যে তন্তু জাতীয় খাবার রাখার চেষ্টা করো। ফল, শাকসবজি এবং গোটা শস্যে তন্তু জাতীয় খাবার পাওয়া যায়। এছাড়াও খাদ্যের মধ্যে দই রাখলে শরীরে সুস্থ ব্যাকটেরিয়া যোগ হবে। প্রচুর "জাঙ্ক ফুড" খাবে না। সেগুলির মধ্যে রয়েছে চিনি বা চর্বিযুক্ত খাবার। যদি কোন খাবার খেলে তোমার পেটে প্রায়ই ব্যথা হয় বা হজমে সমস্যা করে, তাহলে সেই খাদ্যগুলি তোমার খাদ্য থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করো।
সবশেষে, প্রচুর পরিমাণে জল পান করতে ভুলবে না। তুমি যদি এমন কোথাও থাকো যেখানে জল শোধন করা হয় না, নিশ্চিত করো যেন জল প্রথমে ফোটানো হয়। এই পদ্ধতি জলের যে কোন ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলবে এবং জলকে পান করার জন্য নিরাপদ করে তুলবে।