উইকিশৈশব:সৌরজগৎ/বৃহস্পতি/ইউরোপা
ইউরোপা বৃহস্পতির বৃহত্তম উপগ্রহসমূহের একটি। ইউরোপার পৃষ্ঠ বরফে ঢাকা। ইউরোপা বিজ্ঞানীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বের, কারন তারা বিশ্বাস করেন ইউরোপার বরফের নিচে সমুদ্র থাকতে পারে। এবং এই সমুদ্রের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে। যদি সেখানে কোনো অস্তিত্ব থাকে, ধারণা করা হচ্ছে তা পৃথিবীর সকল প্রাণীর থেকে, এমনকি সমুদ্রের প্রাণীর থেকেও অনেক ভিন্ন ধরণের হবে। পার্থক্যসমূহ সম্ভবত খুব এলোমেলো এবং অনেক বড় হবে। উদাহরণস্বরূপ, ঐসকল জীবগুলোতে হয়তো দৃষ্টিশক্তি বিকশিত নাও হতে পারে। এর পরিবর্তে তারা সম্ভবত তড়িচ্চুম্বকীয় বর্ণালীর রেডিও তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ দেখতে পারে। তাদের শরীর সম্ভবত কঠিন পদার্থের না হয়ে তরল বা বায়বীয় হতে পারে!
ইউরোপার তথ্য:
- ইউরোপার বরফ পৃষ্ঠের নিচে একটি মহাসাগর থাকতে পারে
- কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে ইউরোপার মহাসাগরে জীবনের অস্তিত্ব থাকতে পারে
- এই উপগ্রহের বর্তমান নামের আগে এটি কেবল বৃহস্পতি দ্বিতীয় নামে পরিচিত ছিল
- গ্রহাণুপুঞ্জে উপগ্রহটির নামানুসারে ৫২ ইউরোপা নামের একটি গ্রহাণু রয়েছে
ইউরোপা কত বড়?
সম্পাদনাইউরোপার ব্যাস ৩,১২২ কিলোমিটার (পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্থাংশ)। পৃথিবীর ওজন ইউরোপার চেয়ে ১২৫ গুন বেশি, এবং পৃথিবীর আয়তন ৬৭টি ইউরোপার একত্রিত আয়তনের সমান।
এটির পৃষ্ঠ কেমন?
সম্পাদনাইউরোপার পৃষ্ঠ অত্যন্ত মসৃণ এবং কয়েক শত মিটারের বেশি উচ্চতার বৈশিষ্ট্য খুব কমই দেখা গেছে। ইউরোপায় গর্তের সংখ্যাও অনেক কম। এগুলোর মধ্যে ৫ কিলোমিটারের চেয়ে বড় গর্তের সংখ্যা মাত্র তিনটি। এইসব বৈশিষ্ট্য সাধারণত একটি তরুণ পৃষ্ঠকে নির্দেশ করে। এর পৃষ্ঠে ধুমকেতু আছড়ে পরার পরিমানের উপর ভিত্তি করে ইউরোপার পৃষ্ঠের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৩০ মিলিয়ন বা ৩০০ কোটি বছর। এর মসৃণতা এবং অন্যান্য দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যের কারণে একে পৃথিবীর সমুদ্র বরফ হয়ে গেলে যেমন হবে তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করা হয়। মনে করা হয় যে, এর পৃষ্ঠের নিচে তরল পানির একটি স্তর রয়েছে যা জোয়ার -ভাটার কারণে উৎপন্ন তাপের ফলে উষ্ণ থাকে। ইউরোপার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে। এমনকি নিরক্ষরেখায়ও পানির বরফ পাথরের মতো শক্ত। বৃহত্তম গর্তসমূহ সমতল, বিশুদ্ধ বরফ দিয়ে পূর্ণ। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে এবং ইউরোপার জোয়ার ভাটার ফলে উৎপন্ন তাপ হিসাব করে এর পৃষ্ঠের বরফ তলের পুরুত্ব ১০-৩০ কিলোমিটার অনুমান করা হয়েছে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে এর নিচের তরল সমুদ্র ৯০ কিলোমিটার গভীর হতে পারে।
ইউরোপার পৃষ্ঠের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল পুরো পরিমণ্ডল জুড়ে অনেকগুলো অন্ধকার রেখা। পৃথিবীতে বরফের সমুদ্রে ফাটল ধরলে যেমন দেখাতো এগুলো দেখতে অনেকটা সেরকম। এগুলোকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে ফাটলের উভয় পাশে প্রান্তগুলি একে অপরের থেকে দূরে সরে গিয়েছে। ইউরোপার পৃষ্ঠকে একটি ফাটা ডিমের খোসার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বৃহত্তর ব্যান্ডগুলি প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে হালকা পদার্থের একটি কেন্দ্রীয় ব্যান্ডের সাথে রয়েছে। মনে করা হয় যে ইউরোপার ভূত্বকটি নিচের উষ্ণ স্তরগুলি উন্মুক্ত করতে ছড়িয়ে পড়ার কারণে অনেকগুলো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা গিজারের ফলে এগুলো তৈরি হয়েছিল। এরকম ঘটনা পৃথিবীর সমুদ্রতটে দেখা যায়। এই বিভিন্ন ফাটলগুলো বিশেষ করে বৃহস্পতির জোয়ারের ফলে সৃষ্ট চাপের কারণে ঘটেছে বলে মনে করা হয়; ইউরোপার পৃষ্ঠে উচ্চ এবং নিম্ন জোয়ারের সময় ৩০ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং পতন হয় বলে মনে করা হয়।
ধারণা করা হয়, বরফের নিচের সমুদ্রে জীবনের অস্তিত্ব থাকতে পারে। যেসকল বিজ্ঞানীরা এটি ধারণা করেন তাদের মতে পৃথিবীতেও একই কঠিন অবস্থার মধ্যে, যেমন পুরু বরফ স্তর দ্বারা বেষ্টিত অ্যান্টার্কটিকার লেক ভস্টকেও জীবনের সঞ্চার হতে পারে। বর্তমানে যদিও ইউরোপায় প্রাণের অস্তিত্বের পক্ষে কোনো প্রমান নেই, তবে দূষণের সম্ভাবনা এড়াতে প্রচেষ্টা করা হয়েছে। গ্যালিলিও মিশনের মহাকাশযানকে বৃহস্পতি গ্রহে বিধ্বস্ত করে মিশনটি শেষ করা হয়েছিল। মিশনটিকে যদি কেবল পরিত্যক্ত করা হতো, তাহলে জীবাণুমুক্ত না করা যানটি একসময় হয়তো ইউরোপায় পতিত হয়ে পৃথিবীর জীবাণু দিয়ে দূষিত হতে পারতো। এমনটা হলে ইউরোপায় কখনও তার নিজস্ব কোনো জীবনের অস্তিত্ব ছিল কিনা এটি নির্ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পরত। এবং সম্ভবত পৃথিবীর জীবাণু সেখানের স্থানীয় জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলতে পারতো।
ইউরোপার এই সমুদ্রের উপস্থিতি বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অসাধারণ আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছে। রাশিয়া যেমন ভস্টক হ্রদে ড্রিল করার পরিকল্পনা করছে তার পানির নমুনা সংগ্রহের জন্য এবং জীবনের সন্ধানের জন্য, ইউরোপার পৃষ্ঠের বরফ ড্রিল করে এটির মহাসাগর অনুসন্ধান করার উপায় সম্পর্কে প্রচুর জল্পনা রয়েছে। ইউরোপায় জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে পেলে সেটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হবে।
ইউরোপার দিবা দৈর্ঘ্য কত?
সম্পাদনানিজ অক্ষে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে ইউরোপার ৮৫ ঘন্টা (পৃথিবীর হিসেবে ৩ দিন ১১ ঘন্টা) লাগে। বৃহস্পতির চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করতেও ইউরোপার ৮৫ ঘন্টা সময় লাগে। যেহেতু এই সময় দুটি একই, তাই বৃহস্পতি থেকে ইউরোপার কেবল একপাশই দেখা যায়। আমাদের চাঁদও একইরকম, একারনেই আমরা সবসময় চাঁদের শুধু একপাশই দেখতে পাই।
এটি কার নামে নামকরণ করা হয়েছে?
সম্পাদনাইউরোপা জিউসের একজন ভালোবাসার নাম। ইউরোপা ছিলেন একজন ফিনিশীয় রাজকুমারী যাকে জিউস অপহরণ করে ক্রিটে নিয়ে এসেছিলেন।
এটি কিভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল?
সম্পাদনাদুইজন ব্যক্তি ইউরোপা আবিষ্কার করেছিলেন: সাইমন মারিয়াস এবং গ্যালিলিও গ্যালিলেই। গ্যালিলিয় ১৬১০ সালের ৭ই জানুয়ারি এটি আবিষ্কার করেন। সাইমনও প্রায় একই সময়ে স্বতন্ত্রভাবে ইউরোপাকে আবিষ্কার করেছিলেন।