নাক্ষত্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞান/বিষম তারা

এইচআর চিত্রে এমন কিছু সুনির্দিষ্ট অঞ্চল আছে যেখান দিয়ে অতিক্রম করার সময় তারার মধ্যে অরীয় বৈষম্য দেখা যায়, অর্থাৎ তার উজ্জ্বলতা নির্দিষ্ট পর্যায়কালে পরিবর্তিত হতে থাকে। এই অঞ্চলগুলোকে বলা হয় অস্থিতি স্ট্রিপ। সবচেয়ে বিখ্যাত অস্থিতি স্ট্রিপ হচ্ছে শেফালী (সেফেইড) অস্থিতি স্ট্রিপ যেখানে দুই ধরণের বিষম তারা দেখা যায়: আর আর লাইরি এবং চিরায়ত শেফালী তারা। আর আর লাইরি পপুলেশন ২ তারা স্তবকের দূরত্ব পরিমাপের জন্য আদর্শ দূরত্ব নির্দেশক, অন্যদিকে শেফালী বিষম পপুলেশন ১ তারা স্তবকের দূরত্বের আদর্শ নির্দেশক।

১৮৭৯ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ইয়োহান ভিলহেল্ম রিটার দেখিয়েছিলেন যে, কোন সুষম গোলকে রুদ্ধতাপীয় অরীয় স্পন্দন ঘটতে থাকলে সে স্পন্দনের পর্যায়কালকে পৃষ্ঠ অভিকর্ষ এবং ব্যসার্ধ্যের সাথে সম্পর্কিত করা যায়। সমীকরণটি হচ্ছে,

যেখানে

তারার গড় ঘনত্ব, ভর এবং ব্যসার্ধ্যের সমীকরণ থেকে নিচের সম্পর্কটি পাওয়া যায়,

যেখানে Q হচ্ছে স্পন্দন ধ্রুবক। পরবর্তীকালে দেখা যায় এই সম্পর্কটি একটু সংশোধন করে নিলে তারার জন্যও ব্যবহার করা যায়।

সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে পর্যায়কালের মত একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য একটি রাশির সাথে একেবারে গড় ঘনত্বের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় বিষম তারা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

অস্থিতি স্ট্রিপে কাপ্পা প্রক্রিয়া সম্পাদনা

বিষম তারার প্রথম তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন। তিনি দেখেন, তারার ভেতরে বা বাইরে যেকোন প্রক্রিয়ার কারণে যদি অস্থিতিশীলতার জন্ম হয় তাহলে তারাটি স্পন্দিত হবে। অস্থিতিটি যেহেতু আবেশিত ছিল সেহেতু এ ধরণের স্পন্দন খুব দ্রুতই ড্যাম্পড তথা লঘু হয়ে যাবে, মাত্র কয়েক হাজার বছরের মধ্যে। স্পন্দনের কারণ যদি এই হত তাহলে আমরা কোন বিষম তারা দেখতে পেতাম না। তারার ভেতরে শক্তি প্রবাহই তার ব্যসার্ধ্য নির্ধারণ করে। স্থিতিশীল স্পন্দনের জন্য এই শক্তি প্রবাহ এবং তথাপি পুরো ব্যাসার্ধের পর্যায়ক্রমিক স্পন্দন জরুরি।

শক্তির বহির্গামী প্রবাহের এমন স্পন্দন কেবল তখনই সম্ভব যদি তারাটি সংকুচিত এবং প্রসারিত হতে থাকে। সংকুচিত হওয়ার সময় তার এনভেলপের নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলে অনচ্ছতা বাড়ে, যে কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। প্রসারণের সময় উল্টো ঘটনা ঘটে, অনচ্ছতা কমে, যার ফলে সংকোচনের সময় শোষিত শক্তি বিকিরণ করে সে শীতল হতে পারে। এর নামই "কাপ্পা প্রক্রিয়া"।

দেখা গেছে আর আর লাইরি তারার একেবারে বাইরের অংশে আয়নিত হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম অঞ্চলের আকার হ্রাস-বৃদ্ধি এই প্রক্রিয়াতেই ঘটে। উল্লেখ্য আয়নিত হিলিয়াম অঞ্চলের নিম্নতম প্রান্তের উপরে মাত্র   ভর থাকে। এই ক্ষুদ্র ভরের সংকোচন প্রসারণেই আর আর লাইরি তারার আপাত মান প্রায় ২ ধাপ পরিবর্তিত হয়ে যায়, আর ব্যসার্ধ্যের পরিবর্তন ঘটে মোট ব্যাসার্ধের প্রায় ২০%।

অস্থিতি স্ট্রিপ কিন্তু একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, স্ট্রিপটি অনুভূমিক শাখা এবং নীল চক্রকে ছেদ করে। অনুভূমিক শাখার অস্থিতি স্ট্রিপে অবস্থিত তারাগুলো আর আর লাইরি এবং নীল চক্রের অনুরূপ তারাগুলো শেফালী বিষম তারা। প্রশ্ন হচ্ছে এই স্ট্রিপের বাইরের তারাগুলো কেন অস্থিত নয়, তারা কেন স্পন্দিত হয় না? স্ট্রিপের দুটি সীমানা আছে, উত্তপ্ত সীমানা এবং শীতল সীমানা। তারার কার্যকরী তাপমাত্রা উত্তপ্ত সীমানার চেয়ে বেশি হলে সে স্থিতিশীল আবার শীতল সীমার চেয়ে কম হলেও স্থিতিশীল।

এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে আয়নিত অঞ্চলের মাঝেই। তারার উজ্জ্বলতাকে প্রভাবিত করার মত স্পন্দন ক্ষমতা অর্জন করতে হলে আয়নিত অঞ্চলে যথেষ্ট ভর থাকতে হবে, তারার মোট ভরের একটি নির্দিষ্ট অংশ। অর্থাৎ তাকে কম ঘনত্বের পৃষ্ঠ অঞ্চলগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। আয়নিত অঞ্চল যদি একেবারে বহির্পৃষ্ঠের কাছাকাছি হয় তবে তার ভর কম হবে। পৃষ্ঠের কার্যকরী তাপমাত্রা যখন অনেক বেড়ে যায় তখন আয়নিত অঞ্চল পৃষ্ঠের কাছাকাছি চলে আসে, এজন্য অস্থিতি স্ট্রিপে উত্তপ্ত সীমানা দেখা যায়।

আবার তাপমাত্রা যখন অনেক কমে যায় তখন তারার এনভেলপ পরিচলনীয় হয়ে পড়ে যার ফলে কাপ্পা প্রক্রিয়াই আর কাজ করতে পারে না, তথাপি কোন স্পন্দনও থাকে না। এটিই শীতল সীমানার কারণ।

মনে রাখতে হবে, এই প্রক্রিয়াগুলো কেবল তারার বাইরের দিকে ঘটে, ভেতরের শক্তি উৎপাদন এবং প্রবাহের উপর এর কোন প্রভাব নেই।