সমাস হচ্ছে পরস্পর অর্থ সম্পর্কযুক্ত একাধিক পদ বা একটি পদ ও একটি উপসর্গের একপদীকরণ। যেমনঃ সু (ভালো) ব্রত যার = সুব্রত।

অর্থবাচকতা

সম্পাদনা

সমাস শব্দের অর্থ সংক্ষেপ, সমর্থন, সংগ্রহ, মিলন।

সন্ধি ও সমাসের পার্থক্য

সম্পাদনা

সন্ধিতে মিলন ঘটে সন্নিহিত বর্ণের, সমাসে মিলন ঘটে পাশাপাশি থাকা দুই, তিন বা তার বেশি সংখ্যক পদের।যেমন; সংখ্যা+অতীত= সংখ্যাতীত; সংখ্যাকে অতীত= সংখ্যাতীত। সন্ধির কাজ ধ্বনিতে। আর সমাসের কাজ শব্দে।

প্রকারভেদ

সম্পাদনা

সমাস প্রধানত ছয় প্রকার। যথাঃ দ্বন্দ্ব, বহুব্রীহি, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, দ্বিগু এবং অব্যয়ীভাব। (অনেক ব্যাকরণবিদ দ্বিগু কে কর্মধারয় এর অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। অনেকে আবার কর্মধারয় কে তৎপুরুষ এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ দিক দিয়ে সমাস চার প্রকার। তবে অধিকাংশের মতে সমাস ছয় প্রকার।)

এছাড়া কিছু অপ্রধান সমাস আছে। যেমন: অলোপ, বাক্যাশ্রয়ী,নিত্য' ইত্যাদি।

দ্বন্দ্ব সমাস

সম্পাদনা

যে সমাসে সমস্যমান প্রত্যেক পদের অর্থই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় এবং পদ দুটি কোন সংযোজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত থাকে তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমনঃ রূপ ও রস ও গন্ধ ও শব্দ ও স্পর্শ = রূপরসগন্ধশব্দস্পর্শ; অন্ন ও বস্ত্র = অন্নবস্ত্র।

বহুব্রীহি সমাস

সম্পাদনা

যে সমাসে মূখ্যভাবে সমস্যবান পদসমূহের অর্থপ্রতীতি না হয়ে অন্য পদের অর্থ মূখ্যরূপে প্রতীয়মান হয়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যথাঃ পীত হইয়াছে অম্বর যাহার = পীতাম্বর (অর্থ শ্রীকৃষ্ণ)। এর ব্যাসবাক্যে একটি যদ্ শব্দের প্রয়োগ থাকে। দশভুজা=দশহাতের সমাহার যার।

কর্মধারয় সমাস

সম্পাদনা

বিশেষ্যের সাথে বিশেষণের সমাসকে কর্মধারয় সমাস বলে। যথাঃ নীল যে উৎপল = নীলোৎপল। কর্মধারয় সমাসে উত্তর পদের অর্থ প্রধানভাবে থাকে। কর্মধারয় সমাস প্রধানত চার প্রকার। যথাঃ-

১.মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস

সম্পাদনা

কর্মধারয় সমাসে কোন কোন স্থানে মধ্যপদের লোপ হয়। সেজন্যেই একে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে। যথাঃ হিমালয় নামক পবর্ত = হিমালয়পবর্ত। এখানে ‘নামক’ মধ্যপদের লোপ হয়েছে।

২.উপমিত কর্মধারয় সমাস

সম্পাদনা

সমান ধর্মবাচক পদের প্রয়োগ না থাকলে উপমেয় ও উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। যেমনঃ মুখ চন্দ্রসদৃশ = মুখচন্দ্র।

৩.রূপক কর্মধারয় সমাস

সম্পাদনা

উপমেয় পদে উপমানের আরোপ করে যে সমাস হয়, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। এতে উপমেয় পদে রূপ শব্দের যোগ থাকে। যেমনঃ বিদ্যারূপ ধন = বিদ্যাধন। এখানে ‘রূপ’ শব্দের যোগ রয়েছে।

৪.উপমান কর্মধারয় সমাস

সম্পাদনা

উপমানবাচক পদের সাথে সমান ধর্মবাচক পদের মিলনে যে সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। যেমনঃ শশের (খরগোশের) ন্যায় ব্যস্ত = শশব্যস্ত।

তৎপুরুষ সমাস

সম্পাদনা

দ্বিতীয়াদি বিভক্তান্ত পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। এতে উত্তরপদের অর্থ প্রাধান্য থাকে। যেমনঃ লবণ দ্বারা অক্ত (যুক্ত) = লবণাক্ত। "'তৎপুরুষ"' শব্দটির অর্থ হল "তার পুরুষ"। তার পুরুষ এই শব্দ গুলির একপদীকরণে তৎপুরুষ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পূর্ব পদ থেকে সম্বন্ধ পদের বিভক্তি 'র' লোপ পেয়েছে ও উত্তর পদের অর্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। এইভাবে এই সমাসের অধিকাংশ উদাহরণে পূর্ব পদের বিভক্তি লোপ পায় ও উত্তর পদের অর্থ প্রাধান্য থাকে এবং তৎপুরুষ শব্দটি হল এই রীতিতে নিষ্পন্ন সমাষের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ।তাই উদাহরণের নামেই এর সাধারণ নামকরণ করা হয়েছে তৎপুরুষ সমাস। তৎপুরুষ সমাস বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যথাঃ-

(১)দ্বিতীয়া-তৎপুরুষ

সম্পাদনা

দ্বিতীয়া-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে দ্বিতীয়া-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ স্বর্গকে গত = স্বর্গগত।

(২)তৃতীয়া-তৎপুরুষ

সম্পাদনা

তৃতীয়া-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে তৃতীয়া-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ রজ্জু দ্বারা বন্ধ = রজ্জুবন্ধ।

(৩)চতুর্থী-তৎপুরুষ

সম্পাদনা

চতুর্থী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে চতুর্থী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ যজ্ঞের নিমিত্ত ভূমি = যজ্ঞভূমি।

(৪)পঞ্চমী-তৎপুরুষ

সম্পাদনা

পঞ্চমী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে পঞ্চমী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ মুখ হইতে ভ্রষ্ট = মুখভ্রষ্ট।

(৫)ষষ্ঠী-তৎপুরুষ

সম্পাদনা

ষষ্ঠী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে ষষ্ঠী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ দীনের বন্ধু = দীনবন্ধু।

(৬)সপ্তমী-তৎপুরুষ

সম্পাদনা

সপ্তমী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে সপ্তমী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ দিবাতে নিদ্রা = দিবানিদ্রা।

(৭)নঞ্ তৎপুরুষ

সম্পাদনা

নঞ্ অব্যয় পূর্বে থেকে যে সমাস হয়, তাকে নঞ্তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ ন উক্ত = অনুক্ত।

(৮)অলুক তৎপুরুষ

সম্পাদনা

যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্ব পদের দ্বিতীয়াদি বিভক্তি লোপ হয় না তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: ঘিয়ে ভাজা, গরুর গাড়ি, গায়েপড়া ইত্যাদি।

দ্বিগু সমাস

সম্পাদনা

তদ্ধিতার্থে, উত্তরপদ পরে ও সমাহার বুঝালে সংখ্যাবাচক শব্দ পূর্বে থেকে যে সমাস হয়, তাকে দ্বিগু সমাস বলে। তদ্ধিতার্থে, যথাঃ পঞ্চ (পাঁচটি) গো দ্বারা ক্রীত = পঞ্চগু। উত্তরপদ পরে, যথাঃ পঞ্চ হস্ত প্রমাণ ইহার = পঞ্চহস্তপ্রমাণ। [এখানে প্রমাণ শব্দ উত্তরপদ পরে থাকায় পঞ্চ ও হস্ত এই দুই পদের দ্বিগু সমাস হয়েছে]। সমাহারে, যথাঃ ত্রি (তিন) লোকের সমাহার = ত্রিলোকী।দ্বিগু শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল 'দুটি গরু' কিন্তু ব্যাকরণ সম্মত অর্থ হল 'দুটি গরুর মূল্যে কেনা।

অব্যয়ীভাব সমাস

সম্পাদনা

অব্যয় পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয় এবং যাতে পূর্ব পদের অর্থেরই প্রাধান্য থাকে, তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। যেমনঃ আত্মাকে অধি (অধিকার করিয়া) = অধ্যাত্ম।

অন্যান্য সমাস

সম্পাদনা

নিত্য সমাসঃ

সম্পাদনা

যে সমাসে সমস্যমান পদ দ্বারা সমাস-বাক্য হয় না, অন্য পদের দ্বারা সমস্ত পদের অর্থ প্রকাশ করতে হয়, তাকে নিত্য সমাস বলে। যেমনঃ অন্য গ্রাম = গ্রামান্তর।

উপপদ সমাসঃ

সম্পাদনা

কৃদন্ত-পদের পূর্বে যে পদ থাকে, তাকে উপপদ বলে এবং উপপদের সাথে কৃদন্ত-পদের যে সমাস হয়, তাকে উপপদ সমাস বলে। যেমনঃ কুম্ভ করে যে = কুম্ভকার।

প্রাদি সমাসঃ

সম্পাদনা

প্র, পরা প্রভৃতি ২০টি উপসর্গের সাথে তৎপুরুষ সমাস হলে, তাকে প্রাদি সমাস বলে। যেমনঃ সম্ (সম্যক্) যে আদর = সমাদর

বাক্যাশ্রয়ী সমাস

সম্পাদনা

যে সমাসে সমাসবদ্ধ পদগুলি একমাত্রায় লেখা হয় না এমনকী সবসময় পদসংযোজক চিহ্ন দ্বারাও যুক্ত করে লেখা হয় না - বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত এই সমাসকে বলা হয় বাক্যাশ্রয়ী সমাস।যেমন : 'বসে আঁকো প্রতিযোগিতা', 'সব পেয়েছির দেশ', ইত্যাদি।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  • সুবলচন্দ্র মিত্র (১৯৯৫), সরল বাঙ্গালা অভিধান, নিউ বেঙ্গল প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, কোলকাতা।
  • ড. অশোককুমার মিশ্র, বাংলা ব্যাকরণ, রবীন্দ্র লাইব্রেরী।