রুশ ভাষা শিক্ষা/ইতিহাস
দশম শতকের শেষে খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তনের সাথে সাথে রাশিয়াতে লিখিত ভাষার প্রচলন ঘটে। রুশদের খ্রিস্টীয়করণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ধর্মীয় সাহিত্যের ভাষা হিসেবে গির্জা স্লাভীয় ভাষার প্রচলন ঘটে। গির্জা স্লাভীয় ভাষা একটি দক্ষিণ স্লাভীয় ভাষা। ধারণা করা হয় যে, সেই সময়ে গির্জা স্লাভীয় ভাষা এবং প্রাচীন রুশ ভাষার মধ্যে বড় মাত্রার পারস্পরিক বোধগম্যতা ছিল। তবে পূর্ব স্লাভীয় ও দক্ষিণ স্লাভীয় ভাষার মধ্যে যেসব সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে, তা এই দুইটি ভাষার মধ্যেও বিদ্যমান ছিল। এই সময়ে বেশির ভাগ রচনা ছিল ধর্মীয় প্রকৃতির। গির্জার সন্ন্যাসীরা বাইবেলের অনুবাদ, সাধুসন্ততিদের জীবনকাহিনী ইত্যাদি রচনা করতেন। তারা স্থানীয় পূর্ব স্লাভীয় ভাষা ব্যবহার না করে গির্জা স্লাভোনীয় ভাষাতেই রচনা করার চেষ্টা করতেন। তবে মাঝে মাঝেই তাদের লেখার স্থানীয় ভাষার শব্দ ও বৈশিষ্ট্য ঢুকে পড়ত। ধর্মীয় লেখা ছাড়াও আইনি প্রয়োজনে আইনকানুন, উত্তরাধিকারের দলিল, বিভিন্ন চুক্তি, ইত্যাদিও রচিত হত। এই দ্বিতীয় প্রকারের রচনাগুলিতে তৎকালীন পূর্ব স্লাভীয় ভাষার বেশ বড় প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এসময় রাশিয়ার লিখিত ভাষাতে তাই এক ধরনের দ্বিভাষা-অবস্থা (diglossia) বিরাজ করছিল। গির্জা স্লাভীয় "সাধু" ভাষায় যেমন লেখা হত, তেমনি স্থানীয় "চলিত" ভাষাতেও লেখালেখি চলত।
সময়ের সাথে সাথে লিখিত ভাষায় এই পার্থক্যের পরিমাণ কমে আসে। গির্জা স্লাভীয় ভাষার বহু শব্দ ও সংগঠন রুশ কথ্য ভাষার একেবারে নিম্ন-মর্যাদাসম্পন্ন রূপেও প্রচলিত হয়ে যেতে শুরু করে। চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে ও পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে বেশ কিছু দক্ষিণ স্লাভীয় কেরানিকে রাশিয়ার ধর্মালয়গুলিতে উচ্চপদে আসীন করা হয়। এদেরই লেখার প্রভাবে রুশ ভাষার গতি আরেকবার পরিবর্তিত হয়। এরা ধর্মীয় রচনাবলীতে অতিশুদ্ধ প্রাচীন গির্জা স্লাভীয় ভাষা বেশি করে অনুকরণ করতে শুরু করেন। যদিও রুশ নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন রূপগুলিতে ইতোমধ্যেই দক্ষিণ স্লাভীয় বিভিন্ন সংগঠন প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন রূপগুলিতে আরও প্রাচীন একটি গির্জা স্লাভীয় রূপ ব্যবহার হওয়া শুরু হয়, যা ছিল প্রচলিত কথ্য ভাষা থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি দূরবর্তী। ফলে রুশ ভাষাতে দ্বিতীয়বারের মত দ্বিভাষা-অবস্থার সৃষ্টি হয়।
১৮শ শতকে এসে সম্রাট মহান পিওতর রাশিয়ার আধুনিকীকরণ ও ধর্মনিরপেক্ষীকরণ সাধন করেন। এসময় শিক্ষিত লোকেদের মুখে প্রচলিত ভাষার একটি লিখিত রূপ উদ্ভাবনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৭৫৫ সালে রুশ বহুশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত লোমোনোসফ তাঁর রুশ ব্যাকরণে তিনটি ভিন্ন ভাষারীতির একটি তত্ত্ব প্রদান করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে রুশ ভাষার একটি উচ্চ রীতি থাকবে, যাতে ধর্মীয় রচনাবলী ও উচ্চস্তরের কাব্য রচিত হবে। আরও থাকবে একটি নিম্ন রীতি, যা প্রায় সম্পূর্ণতই পূর্ব স্লাভীয় ভাষা; এই রীতিটি ব্যক্তিগত যোগাযোগে এবং লঘু নাটকে ব্যবহার করতে হবে। আর থাকবে একটি মধ্য রীতি, যাতে ছন্দকবিতা, সাহিত্যিক গদ্য এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখিত হবে। আধুনিক আদর্শ রুশ ভাষার সাথে এই মধ্য রীতির মিল সবচেয়ে বেশি। ১৯শ শতকের শুরুতে বিখ্যাত রুশ লেখক পুশকিনের সময়ে আধুনিক আদর্শ রুশ ভাষার আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা ঘটে। এর পর দুই শতাব্দী ধরে ভাষাটির বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটলেও আধুনিক রুশ ভাষা বলতে পুশকিনের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রচলিত রুশ ভাষাকেই বোঝায়।
রুশ ভাষার একেবারে প্রাচীন রূপ থেকে বর্তমান আধুনিক রূপ পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণ স্লাভীয় ভাষার বিভিন্ন রূপ ও সংগঠনের দ্বৈত সহাবস্থান ভাষাটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। আধুনিক রুশ ভাষায় প্রায়শই একই ধারণার জন্য একই শব্দমূল থেকে সাধিত দুইটি শব্দ দেখতে পাওয়া যায়, যাদের একটি হল গির্জা স্লাভীয় সংস্করণ এবং অন্যটি পূর্ব স্লাভীয় সংস্করণ।
রুশ ভাষার প্রাচীন পর্যায়ে ভাষাটি মূলত উত্তর ও দক্ষিণে দুইটি ঔপভাষিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। মস্কো শহরের মধ্য দিয়ে কল্পিত পূর্ব-পশ্চিমে চলে যাওয়া একটি অক্ষরেখার উত্তরে ও দক্ষিণে ছিল এই দুই উপভাষার অবস্থান। দক্ষিণের উপভাষাটির সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। উত্তরের উপভাষাটির বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নভোগোরাদ শহর। উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে এসময়ে প্রতিষ্ঠিত কিছু পার্থক্য এখনও রুশ কথ্য উপভাষাগুলিতে রয়ে গেছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাশিয়া তাতারদের পদানত হয়। অন্যদিকে ইউক্রেন ও বেলারুশ প্রথমে লিথুয়ানিয়া ও পরে পোলীয়দের সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। এসময়েই ভাষা তিনটি একে অপরের থেকে পৃথক হতে শুরু করে। রুশ ভাষা ধ্বনিব্যবস্থায় এসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে: শ্বাসাঘাতহীন o (ও)-কে a (আ) হিসেবে উচ্চারণ করা শুরু হয় (যেমন doma ("বাড়িগুলি")-কে দোমা-র পরিবর্তে দামা উচ্চারণ করা)। এই পরিবর্তনটি (যার নাম দেওয়া হয়েছে "আকানিয়ে") প্রথমে দক্ষিণ রাশিয়ায় শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে মধ্য রাশিয়ার কিছু অঞ্চলেও প্রচলিত হয়ে যায়। উত্তর রাশিয়ার ভাষাতে এই পরিবর্তনটি ঘটেনি (এর নাম দেওয়া হয়েছে "ওকানিয়ে")। পঞ্চদশ শতকে তাতারদের বিরুদ্ধে রুশদের সংগ্রামে ও পরবর্তীকালে একতাবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার আবির্ভাবে মস্কো অঞ্চল প্রধান ভূমিকা পালন করে। মস্কো ছিল একটি আকানিয়ে এলাকা, এবং এখানকার ভাষায় উত্তর ও দক্ষিণ উপভাষা অঞ্চলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন ঘটেছিল। ফলে মস্কো ও এর আশেপাশে একটি মধ্যবর্তী ঔপভাষিক এলাকার সৃষ্টি হয়। এই মধ্য রুশ উপভাষাটিই পরে আদর্শ আধুনিক রুশ ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে দেয়। রুশ লিপিতে আকানিয়ে আলাদাভাবে বোঝানো হয় না, কিন্তু মস্কোর কথ্য ভাষাতে ব্যবহারের সুবাদে আধুনিক আদর্শ রুশ উচ্চারণের এটি একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। রুশ ভাষা একটি বিশাল এলাকা জুড়ে প্রচলিত হলেও ঔপভাষিক বৈচিত্র্য খুবই কম, এবং শিক্ষার বিস্তারের সাথে সাথে এই পার্থক্য আরও হ্রাস পাচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীতে এসে রুশ ভাষা রাশিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে অন্য বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত অ-রুশ প্রজাতন্ত্রে রুশ ভাষাই ছিল মূল সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে রুশ ভাষায় কথা বলতে পারেন, এরকম লোকের সংখ্যা বিশাল। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময় অন্য আরও পাঁচটি ভাষার সাথে রুশ ভাষাও একটি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা পায়।