আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য অনুধ্যান

বৈচিত্র্যে ঐক্য ও ক্ষমতায়নে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ

মানিক ইসাহাক বিশ্বাস (Manik Esahak Biswas, A Social Development Worker)


৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এটি নারী ও মেয়েদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সকল অর্জনকে স্বীকৃতি ও উদযাপন করার একটি বিশ্বব্যাপী দিবস। এটি নারী পুরুষের সমতা অর্জনের দিকে অগ্রগতি এবং আগামীর বাকি কাজ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতেও একটি পদক্ষেপ গ্রহণের মুহুূর্ত। আমরা বিশ্বাস করি যে, পারস্পরিক সৌহার্দ, সম্প্রীতি, শালীনতাবোধ, ধের্য্য এবং পরমত সহিষ্ণুতা আমাদেরকে বিশ্ব শান্তি উদ্যাপনে সহায়তা করবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের দিকে পালিত হতে দেখা যায়। এটি উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের শ্রম আন্দোলনের কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং সমাজে নারীদের সমান অংশগ্রহণের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান আহ্বানকে সর্বস্তরে প্রতিফলিত করেছে। অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে ১৯ মার্চ ১৯১১ সালে সর্ব প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস অনুষ্ঠিত হয়। সেই দিন, এক মিলিয়নেরও বেশি মহিলা এবং পুরুষ তাদের সমর্থন জানাতে জনসাধারণের ইভেন্টে এবং সভায় অংশ নিয়েছিলেন। অন্যান্য দেশগুলি পরবর্তী বছরগুলিতে এই দিনটিকে পালন ও উদযাপন করতে শুরু করে। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালকে আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। আজ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস হল একতা, উদযাপন, প্রতিফলন, বৃহত্তর কণ্ঠস্বরকে জাগ্রত করা এবং কর্মের মাঝে কর্মী মিলনের একটি শুভ দিন যা বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে পালিত হয়। মার্চ মাস হল নারীদের ইতিহাসের মাস - একটি সময় যা নারীদের প্রতিফলন এবং উদযাপনের জন্য ইতিহাস জুড়ে তাদের কৃতিত্বের জন্য নিবেদিত। ৮ ই মার্চ, আমরা বিশ্বব্যাপী নারীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শৈল্পিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবকে স্মরণ, অনুপ্রাণিত ও মানব সভ্যতার উন্নয়নকে প্রভাবিত করতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করি। ট্যালেন্ট ব্যুরো একটি সংস্থা যা অনেক নেতৃস্থানীয় নারী বক্তাদের সাথে আলোচনা করেছে। এই নারীদের প্রত্যেকে মানসিকভাবে সমতাকে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করে সামনে এগিয়ে গিয়েছেন ক্রমাগত নিজেদের গন্ডি পেরিয়ে। অনেক বাধা বিপত্তি জয় করে। তারা নারী ও পুরুষের সমতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের নিজ নিজ কাজের মধ্যে অবিশ্বাস্য পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা বিশ্বাস করেছে যে তাদের আবেগ, সংকল্প এবং অনন্য দক্ষতার মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নতুন পথ পরিক্রমা তৈরিতে তারা ভূমিকা রাখছে ভবিষ্যতের নারীদের জন্য যাতে আগামীর পৃথিবী একটু হলেও অন্য নারীদের জন্য সহজতর ও যুগোপযোগী হয়। যেখানে প্রত্যেক নারীই হবে বিজয়ী ও জয়ী।

বর্তমান কর্মব্যস্ত সমাজ ও পৃথিবীতে নারীরা বাইরের কাজেও পুরুষের সাথে সমানতালে অংশগ্রহণ করছে। সুতরাং একটি সাংগঠনিক পরিমন্ডলের কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে নারীদেরকে সমানভাবে লড়াই করতে হয়। নারী ও প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েদের চাহিদা, আগ্রহ এবং আকাক্ষাকে মূল্যবান এবং অন্তর্ভুক্ত করা নিশ্চিত করার অনেক উপায় একটি সংস্থায় রয়েছে। কর্মপন্থায় কৌশলগত পরিকল্পনায় সংস্থাসমূহ যদি অধিকতর সংবেদনশীল হয়ে আচরণ করে তবে সমতার বিশ্ব গড়ে উঠবে সহজেই। নিমোক্ত পরিকল্পনা নারীদেরকে এগিয়ে দিতে পারে অনেকাংশে:-

  • নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন গঠন
  • নারীর প্রতিভা মূল্যায়ন ও নিয়োগ পক্রিয়ায় যর্থার্থ নিরীক্ষণ করা, ধরে রাখা এবং মানবিক বিকাশের ব্যবস্থা করা
  • নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ব্যবসা এবং সামাজিক উদ্যোগে নারী ও মেয়েদের সমর্থন করা
  • নারীবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ
  • নারী এবং বয়সন্ধিকালীন মেয়েদের তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা প্রদান ও সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা
  • টেকসই কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় নারী ও মেয়েদের সম্পৃক্ত করা
  • মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নারী ও মেয়েদের প্রবেশাধিকার প্রদান
  • খেলাধুলায় নারী ও মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করানো এবং কৃতিত্ব বৃদ্ধি করা
  • নারী ও মেয়েদের সৃজনশীল এবং শৈল্পিক প্রতিভা প্রচার করা, প্রতিভাকে সমুজ্জ্বলিত করার লক্ষ্যে প্রয়াস গ্রহণ করা
  • নারী ও মেয়েদের অগ্রগতি সমর্থনকারী সেক্টর সমূহকে শক্তিশালী করা এবং উক্ত ক্ষেত্রগুলিকে পৃষ্টপোষকতার আওতায় এনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও বলয় রচনা করা।

২০২৪ সালে, ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এই দিনের প্রচারাভিযানের থিম Inspire Inclusion যার অর্থ হলো সমাজের সকল ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এবং ক্ষমতায়নের গুরুত্বের উপর জোর দেয়। এর অর্থ হলো নারী শক্তি জাগরিত হোক সকলের অন্তরে। মননে। মানসপটে। এই শক্তি সকল বাধাগুলি ভেঙে ফেলার জন্য, স্টেরিওটাইপগুলিকে (সামাজিক কুসংস্কার এবং কুপ্রথা-যা চলার পথে বাধা দেয় সেগুলোকে) চ্যালেঞ্জ করার এবং এমন পরিবেশ তৈরি করার জন্য পদক্ষেপের আহ্বান জানায় যেখানে সমস্ত নারীকে মূল্যবান এবং সম্মান করা হয়। ইন্সপায়ার ইনক্লুশন প্রত্যেককে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের নারীসহ জীবনের সর্বস্তরের নারীদের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবদানকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করে। সমাজের প্রতি পদক্ষেপে যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তাদেরকে আহ্বান করা হলো আজ এই দিনের মূল প্রতিফলিত বিষয়বস্তু। বিধবা। প্রতিবন্ধী নারী। দুর্বল বয়স্কা নারী। সন্তান হারা মা। স্বামী পরিত্যক্তা (স্বামী না থাকার কারণে সামাজিকভাবে নির্যাতিত নারী)। সারাদিন ক্লান্ত -শ্রান্ত আদিবাসী নারী, যে কি না জানে না বা কোন দিন শুনে নি বা শুনবেও না যে, বিশ্ব নারী দিবস বলে কোন বিশেষ দিন আছে। তারা। হিজড়া জনগোষ্ঠী যে তার সারাদিন নির্বাহ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা কালেকশন/সংগ্রহ করে। তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ভিক্ষক মা যখন সন্তানের মুখে পানি তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সফল হয় না। তাদেরকে কৃতিত্ব দেওয়ার দিন হলো এই আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

উল্লেখ্য যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন নারী কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। মানসিক সমস্যার প্রাদুর্ভাব পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়। নারীদের মধ্যে সাধারণত যেসব মানসিক সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো হল- হতাশা, এবং উদ্বেগ। এই দু’টো সমস্যা ছাড়াও নারীদের একান্ত নিজস্ব যে মানসিক সমস্যাগুলো হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গর্ভকালীন বিষন্নতা, মাসিকের আগে ও পরে ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন হওয়া, মেনোপজের আগে ও পরে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দেওয়া। তাছাড়া ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, আর্থিক সংকট এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্যেও বেড়াজাল তো নিত্য দিনের সঙ্গী। নারীদের মানসিক সমস্যাগুলোকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজ এড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু এই সমস্যাগুলো নারীদের বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং নিরাপদ ও নিরাপত্তা উভয় সংকট সমাধান ও সমূলে উৎপাটন প্রয়োজন। সময় এসেছে সর্বক্ষেত্রে নারীদের অন্তর্ভুক্তিকে অনুপ্রাণিত করা। যার প্রকৃত অর্থ হল নারীদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা এবং ক্ষমতায়ন প্রয়াশকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪ এ বাস্তবে রূপদান করা এবং সত্যসন্মত ভাবে তা স্বীকার ও উদ্যাপন করা। আজ হলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সেই মহতী লগ্ন যখন আমরা বিশ্বব্যাপী নারী দিবস (ওডউ) উপলক্ষ্যে নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অর্জনের ক্ষেত্রসমূহকে যর্থার্থ সন্মাননা প্রদান করে থাকি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতি বছর, এই দিনটি সমতার অধিকার ভিত্তিতে অগ্রগতির একটি শক্তিশালী অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে এবং যে কাজগুলি এখনও করা দরকার তা আগামীর এজেন্ডা হিসাবে সন্মুখে প্রতিফলিত করে। “বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি, চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দ্বারা রচিত এই পঙক্তিগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায় নারীরা হলেন সমাজের অন্যতম সঞ্চবনী শক্তি। পুরুষের চলার পথের পাথেয় অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে পরিবারের মায়ের উপরে। সুস্থ-নিরপেক্ষ সমাজ বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন সুন্দর-অর্থবহ এবং সুশৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণের প্রয়াশে। নারীশক্তির বিকাশ ও সমাজে নারীদের সুস্পষ্ট অবস্থান তৈরির লক্ষ্যে প্রতিবছর ৮ই মার্চ বিশ্বজুড়ে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” পালন হয়ে উঠুক সকলের অনুপ্রেরণার উৎসস্থল। আলোকবর্তিকা স্বরূপা নারীরা বিশ্ব জয়ের মন্ত্রে, সন্তানের সাফল্যে, নিজেদের গৌরবে অপার সৌন্দর্যের পদচারনায় ভরিয়ে তুলুক বিশ্ব দরবার সাম্যতা, একতা, শৃঙ্খলা, ভালবাসা ও প্রেমের শীতলতায়। ন্যায্যতা, সাম্যতা ও সমতার অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজব্যবস্থায় যুগ যুগ কৃতিত্ব হোক নারীদের সাফল্যগাঁথা সমানতালে আকাশচুম্বী সফলতার আলিঙ্গনে। সকল নারীদেরকে এই দিনে শুভেচ্ছা। মা। বোন। মামী-মাসী-পিসি। মাতৃধন্য সকল নারী। স্ব-স্ব সফলতায় কৃতিত্ব, বন্দিত, আরাধিত ও নন্দিত হোক যুগেযুগান্তরে।