হাঁস-মুরগি পালন/হাঁস-মুরগির বাচ্চা পালন

অল্প বয়সে পালক না হওয়ায় বা ছোট থাকায় শরীর আবৃত হয় না। এ জন্য শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য কৃত্রিম তাপের প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় কৃত্রিমভাবে তাপ দেয়াকে ব্রুডডিং বলা হয়। ব্রুডডিং দুই ভাবে করা যায়।

  1. প্রাকৃতিক ব্রুডডিং: কুঁচে মুরগির সাহায্যে প্রাকৃতিক ব্রুডডিং করা হয়।
  2. কৃত্রিম ব্রুডডিং: বৈদ্যুতিক, গ্যাস, কেরোসিন ও অন্যান্য তাপের উৎসের মাধ্যমে ব্রুডডিং করাকে কৃত্রিম ব্রুডডিং বলা হয়।

ব্রুডডিং ঘর

সম্পাদনা

খামারের লেয়ার বাচ্চা পালন করার জন্য তিন প্রকার ঘরের ব্যবহার করা হয়। যেমন- ক) ব্রুডার হাউজ, খ) ব্রুডার-কাম-গ্রোয়ার হাউজ, গ) ব্রুডার-কাম- লেয়ার হাউজ।

ব্রুডার হাউজ

সম্পাদনা

স্বতন্ত্র ব্রুডার ঘরের আকার ছোট হওয়াতে তাপ উৎপাদন খরচ কম। এই ঘরে বাচ্চা ব্রুডডিং শেষে বাচ্চাগুলোকে বিক্রি বা গ্রোয়ার হাউজে স্থানান্তর করা হয়। এই সময়ে বাচ্চা স্থানান্তর করলে বাচ্চার ধরুল হয় ও রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা বাড়ে।

ব্রুডার ঘর কাম গ্রোয়ার হাউজ

সম্পাদনা

বর্তমানে এই ঘরের প্রচলন বেশি। ঘরের মধ্যে কিছু স্থান পৃথকভাবে ব্রুডডিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় এমন ভাবে তৈরি করা হয়। পরে গ্রোয়িং অবস্থায়ও সেখানেই রাখা হয়। বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে স্থানের প্রয়োজন বেশি হতে থাকলে পর্দা সরিয়ে বাচ্চা থাকার স্থান প্রশস্ত করা হয়। লেয়ার ঘরে স্থানান্তরের পূর্ব পর্যন্ত এ ঘরে পুলেট পালন করা হয়।

ব্রুডার-কাম-লেয়ার হাউজ

সম্পাদনা

এই ঘরে বাচ্চা পালন ও বাড়ন্ত বাচ্চা পালন শেষে ডিম পাড়া পর্যন্ত মুরগি পালন করা হয়।

প্রতি ব্যাচে বাচ্চার সংখ্যা

সম্পাদনা

খামারের প্রয়োজন ও ঘরের ধারণ ক্ষমতানুসারে প্রতি ব্যাচে বাচ্চা পালন করার জন্য বাচ্চার সংখ্যা নির্ধারণ করতে হয়। বাণিজ্যিক খামারে ব্রুডার-কাম-গ্রোয়ার হাউজে পুলেট প্রতি গড়ে এক বর্গফুট স্থান হিসেবে বাচ্চার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। ৪ ফুট ব্যাসের হোভারের নিচে সাদা জাতের বাচ্চা ৫০০ টি, রঙিন জাতের বাচ্চা ৪৭৫ টি এবং ব্রয়লার বাচ্চা ৪৫০ টি ব্রুডডিং করা হয়। এই হিসেবে ঘরে ব্রুডারের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। ঘরের আয়তন ও বাচ্চার সংখ্যানুসারে ঘরে ব্রুডার স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। সকল সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত শতকরা ৫টি বাচ্চা বেশি পালন করা হয়।

বাচ্চা ব্রুডডিং ব্যবস্থাপনা

সম্পাদনা

ব্রুডার ঘর প্রস্তুতকরণ

সম্পাদনা
  • ব্রুডার ঘর/ব্রুডার-কাম গ্রোয়ার ঘর খালি হওয়ার সাথে সাথে ঘরের সমস্ত সরঞ্জাম, লিটার/এডডিং খাঁচা ইত্যাদি বের করতে হয়।
  • ঘরের কোনো সংস্কার প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা নিতে হয়।
  • ঘরের মেঝেতে লেগে থাকা ময়লা পানি দিয়ে ভিজিয়ে তুলে ফেলতে হয়।
  • পরিষ্কার পানি দ্বারা সমস্ত ঘর ধুয়ে ফেলতে হয়।
  • ভেন্টিলেশন, ফ্যান, লাইট, দরজা জানালা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করতে হয়।

ঘর জীবাণুমুক্তকরণ

সম্পাদনা
  • জীবাণুনাশক ব্যবহৃত পানিতে ব্রাশ ভিজিয়ে ভেন্টিলেশন, ফ্যান, লাইট, দরজা জানালা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করতে হয়।
  • ঘরের মেঝেতে আইয়োসান/ফিনাইল/স্যাভলন/ ডেটল ইত্যাদি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়।
  • অথবা অল্প খরচের জন্য ভেজা ঘরে মেঝের উপর প্রতি ১০০ বর্গ ফুট স্থানে এক কেজি কাপড় কাচা সোডা ভালোভাবে ছড়িয়ে ১৫ মিনিট পরে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হয়।
  • ঘর পরিষ্কার করার সময় ও জীবানুনাশক ব্যবহারের সময় পায়ে গাম বুট, দেহে এপ্রোন ও মুখে মুখোশ ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।

ঘরে লিটার/খাঁচা ও সরঞ্জামাদি স্থাপন

সম্পাদনা
  • ঘর জীবাণুমুক্ত হওয়ার পর ভালোভাবে শুকাতে হবে (১০-১৫ দিন)।
  • শুকনা মেঝের উপর ২ ইঞ্চি পুরু করে লিটার সামগ্রী বিছানোর পর ব্রডার গার্ড, হোভার, হিটার ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে স্থাপন করতে হয়।
  • ব্রুডার গার্ডের এক ফুট ভিতরে ড্রিংকার ও খাদ্য পাত্র স্থাপনের জন্য স্থান রাখতে হয়।
  • খাঁচায় ব্রুডিং করলে লিটারের পরিবর্তে ব্রুডার খাঁচা স্থাপন করা হয়।
  • ব্রুডার-কাম-গ্লোয়ার হাউজের উন্মুক্ত স্থান পর্দা দ্বারা ঢেকে দিতে হয়। গরমকালে চটের পর্দা এবং শীত ও বর্ষার সময় প্লাস্টিক পর্দা ব্যবহার করা হয়।
  • ব্রুডার-কাম-গ্রোয়ার হাউজে বাচ্চা ব্রুডডিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট স্থান প্লাস্টিক পর্দা দ্বারা ঘিরে পৃথক করতে হয় এবং ঘেরা স্থানে ব্রুডার স্থাপন করতে হয়।

ব্রুডার ও ঘরের তাপমাত্রা

সম্পাদনা

ঘরের তাপমাত্রা

সম্পাদনা

ঘরে বাচ্চা প্রদানের সময় ঘরের তাপমাত্রা ৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকে এবং ব্রুডডিং শেষে ৬৫-৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট রাখা হয়।

ব্রুডারের তাপমাত্রা

সম্পাদনা
বাচ্চার বয়স (সপ্তাহ) লেয়ার বাচ্চা ব্রয়লার বাচ্চা
শীতকাল গ্রীষ্মকাল শীতকাল গ্রীষ্মকাল
ফা. সে. ফা. সে. ফা. সে. ফা. সে.
১-২ ৯৫.০ ৩৫.০ ৯১.০ ৩২.৭ ৯০.০ ৩২.২ ৮৬ ৩০
২-৩ ৯০.০ ৩২.২ ৮৬.০ ৩০.০ ৮৫.০ ২৯.২ ৮১.০ ২৭.২
৩-৪ ৮৫.০ ২৯.৪ ৮১.০ ২৭.২ ৮০.০ ২৬.৬ ৭৫.০ ২৩.৮
৪-৫ ৮০.০ ২৬.৬ ৭৫.০ ২৩.৮ ৭৫.০ ২৩.৮ - -
৫-৬ ৭৫.০ ২৩.৮ - - - - - -

ব্রুডার চালু ও পাত্রে পানি প্রদান

সম্পাদনা
  • বাচ্চা গ্রহণের দিন ব্রুডারে পানির পাত্রে পানি দেয়ার পর এবং বাচ্চা গ্রহণের ৩ ঘন্টা পূর্বে ব্রডার চালু (তাপ উৎপাদন) করতে হয়। বেশি আগে চালু করলে লিটার বেশি শুকিয়ে যায় এবং পরে চালু করলে পানির তাপমাত্রা যথেষ্ট পরিমাণ হয় না। পানির তাপমাত্রা ৬৫ ফা. (১৮. সে.) হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই সময় প্রশস্ত খাদ্য পাত্র হিসেবে কাগজ/চিক বাক্সের ঢাকনি/প্লাস্টিক ট্রে হোভারের নিচে স্থাপন করা হয়।

ব্রুডারে বাচ্চা প্রদান

সম্পাদনা
  • খামারে বাচ্চা পৌঁছানোর সাথে সাথে (পূর্ব থেকে প্রস্তুত) পরিচর্যাকারী বাচ্চার সরবরাহ গ্রহণ করবে এবং দ্রুত ব্রুডারে প্রদান করবে।
  • সাধারণত সকালের দিকে ব্রুডারে বাচ্চা প্রদান করলে পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় এবং সকালে আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকার দরুণ কম ধকল সৃষ্টি হয়।
  • বাচ্চা গ্রহণের সময় চিক বাক্সের ভিতর মৃত বাচ্চা থাকলে তার সংখ্যা হিসাব করতে হয়।
  • সম্ভব হলে বাচ্চার প্রাথমিক নমুনা ওজন রাখা যায়।
  • বাচ্চা সরবরাহ তালিকার সাথে কোনো অমিল থাকলে হিসাবে আনতে হয় এবং বাচ্চা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করতে হয়।

বাচ্চার আচরণ পরীক্ষা

সম্পাদনা

ব্রুডারে বাচ্চা প্রদানের পর বাচ্চার আচরণ পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার আচরণ দেখে অনুমান করতে হয় ঘরে বাচ্চার জন্য অনুকূল তাপমাত্রা আছে কি না।

  • ব্রুডারে তাপ বেশি হলে বাচ্চা তাপের উৎস হতে দূরে যায় এবং ব্রুডার গার্ডের গা ঘেঁষে জমা হয়।
  • ব্রুডারে তাপ কম হলে তাপের উৎসের নিচে বেশি তাপের আশায় বাচ্চা ভিড় করে এবং পরস্পর জড়াজড়ি করে গরম হতে চেষ্টা করে। এই অবস্থায় চাপাচাপিতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বাচ্চা মারা যায়।
  • তাপ বাচ্চার অনুকূলে থাকলে বাচ্চা স্বতঃস্ফূর্ত থাকে এবং সুষ্ঠুভাবে খাদ্য খায় ও পানি পান করে।
  • বাচ্চা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলাচল ও পানি পান না করলে বুঝতে হবে বাচ্চা পরিবহণজনিত ধকলে পীড়িত অথবা অসুস্থ।
  • হোভার অথবা তাপের উৎস উঁচু-নিচু করে তাপ কম-বেশি করা হয়। ব্রুডারে বাচ্চা দেয়ার পর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বার বার ব্রুডার ঘরে প্রবেশ করে আচরণ পরীক্ষার পর ব্যবস্থা নিতে হবে। ২ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চার জন্য অত্যন্ত সংকটময় সময়।
  • হঠাৎ করে আলো নিভে যাওয়া, ঘরের তাপমাত্রা পরিবর্তন, ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা, খাদ্য ও পানির পরিবর্তন, বিভিন্ন প্রকার শব্দ ও হট্টগোল বাচ্চার ধকল সৃষ্টি করে। বাচ্চার আচরণ দেখে এ সমস্ত ধকল। প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • ব্রুডারে বাচ্চা প্রদানের পর তারা পানি পান করে। ব্রুডারে বাচ্চার পানি পান করার প্রবণতা পরীক্ষা করতে হয়। প্রতিটি বাচ্চা যাতে সহজে পানি পান করতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হয়। প্রয়োজন হলে হাতে ধরে পানি পান করাতে হয়।

খাদ্য প্রদান

সম্পাদনা

ব্রুডারে বাচ্চা প্রদানের ২-৩ ঘণ্টা পর প্রতিটি বাচ্চার পানি পান নিশ্চিত হয়ে প্রাথমিক পারে স্টার্টার রেশন প্রদানের পূর্বে গম, ভুট্টা চূর্ণ অথবা চাউলের খুঁদ দেয়া যায়।

লিটার ব্যবস্থাপনা

সম্পাদনা
  • লিটার বেশি ভিজা হলে যেমন বিভিন্ন প্রকার গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তেমনি কক্সিডিয়া, কৃমি ও রোগ জীবাণুর বংশ বিস্তার ঘটে। তাছাড়া বাচ্চার দেহে পালক গজানোর হার কমে যায়।
  • বাচ্চা তাপের উৎসের নিচে বেশি জমা হওয়ার কারণে সেখানে বেশি মলত্যাগ করে, ফলে লিটার দ্রুত আর্দ্র হয়।
  • আবার লিটার বেশি শুকনা হলে বাচ্চার দেহ হতে জলীয় অংশ শোষিত হয়ে ডি-হাইড্রেশন হয়।
  • লিটার সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে এ অবস্থা এড়ানো যায়।

ব্রুডার স্থানান্তার

সম্পাদনা
  • প্রতি সপ্তাহে ব্রুডারের তাপমাত্রা ৫০ ফা. কমাতে হয় যতক্ষণ না তাপমাত্রা ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার (৭৫.০ ফা.) সমান হয়।
  • বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে বাচ্চা প্রতি বেশি স্থান প্রদানের জন্য ব্রুডারের চারদিকের ঘেরাও দেয়া পর্দা এবং ব্রুডার গার্ড সরিয়ে স্থান প্রশস্ত করতে হয়।
  • গ্রীষ্মকালে ২ সপ্তাহ এবং শীতকালে ৩ সপ্তাহ বয়সের পর এই পর্দা ও ব্রুডার গার্ডের প্রয়োজন হয় না।
  • গ্রীষ্মকালে ৩ সপ্তাহের পর এবং শীতকালে ৪ সপ্তাহের পর ব্রুডার তাপের প্রয়োজন হয় না, এ সময়ে হোভার উঁচুতে তুলে রাখা হয়।

ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা

সম্পাদনা
  • ঘরের উন্মুক্ত স্থানে ব্যবহৃত পর্দা ২ সপ্তাহ বয়সের পর দিনের বেলা খুলে দেয়া হয় এবং রাত্রে বন্ধ করতে হয়।
  • সাধারণত উন্মুক্ত ঘরে পর্দা খুলে দেয়া এবং রাত্রে বন্ধ করাই যথেষ্ট নয় বরং উন্নতমানের পুলেট তৈরির জন্য আবহাওয়ার অবস্থা বুঝে দিন রাত্রের মধ্যে কয়েকবার পর্দা খোলা ও বন্ধ করার প্রয়োজন হয়।