উইকিশৈশব:সৌরজগৎ/মঙ্গল
- মঙ্গলপৃষ্ঠের পাথরে মরিচা থাকার কারণে মঙ্গল লাল
- মঙ্গলগ্রহের একটি আগ্নেয়গি অলিম্পাস মনস আমাদের সৌরজগতের সর্বোচ্চ পর্বত।
- মঙ্গল গ্রহের মেরুতে বরফের আচ্ছাদন রয়েছে যা পৃথিবীর মতো দেখতে।
- মঙ্গল গ্রহে প্রাচীন নদীখাত রয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন সেখানে লক্ষ লক্ষ বা কোটি বছর আগে পানি প্রবাহিত হতো।
- মঙ্গলগ্রহের টুটিং ক্রেটারটি লন্ডনের একটি শহরতলির নামে নামকরণ করা হয়েছিল কারণ আবিষ্কারক "ভেবেছিলেন [তার] মা এবং ভাই মঙ্গলগ্রহে একটি ভূমি ফর্মের সাথে তাদের নিজের শহরকে জোড়া দিয়ে একটি লাথি মেরে বের করে দেবে"।
মঙ্গল হচ্ছে সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ। এটিকে পাথুরে বা স্থল গ্রহ বলা হয়, কারণ এর বাইরের স্তর পৃথিবীর মতো পাথুরে উপাদান দিয়ে তৈরি।
মঙ্গল কত বড়?
সম্পাদনামঙ্গল সৌরজগতের আটটি প্রধান গ্রহের মধ্যে দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম। শুধু বুধ গ্রহই মঙ্গলের চেয়ে ছোট। এটি প্রায় ৭,০০০ কিলোমিটার (কিমি) প্রশস্ত। অর্থাৎ এর প্রস্থ পৃথিবীর প্রস্থের অর্ধেকের চেয়ে বেশি প্রস্থ। এর আয়তন পৃথিবীর আয়তনের প্রায় ১৫%। পৃথিবীর অনেকটা অংশই পানিতে আচ্ছাদিত হওয়ায় মঙ্গলের মোট পৃষ্ঠভাগ পৃথিবীর প্রায় সম্পূর্ণ স্থলভাগের চেয়ে বড়। ধারণা করা যায় যে, এর এই আকারের ফলে ভবিষ্যতে হয়তো মঙ্গলের বুকে মানব বসতি গড়ে উঠতে পারে।
এই গ্রহের পৃষ্ঠভাগ কেমন?
সম্পাদনামঙ্গলের পৃষ্ঠভাগ অনেকটাি পৃথিবীর মরুভূমির মতো। এটি খুব শুষ্ক এবং ধুলোময়। পৃথিবীর তুলনায় সূর্য থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় এটি খুব ঠান্ডা। সেখানে প্রচুর আলগা পাথর এবং সূক্ষ্ম বালির টিলা রয়েছে। এর "ইমপ্যাক্ট ক্র্যাটার"গুলো পৃষ্ঠকে চিহ্নিত করে, তবে এগুলি চাঁদের মতো সাধারণ নয়। এসব ইমপ্যাক্ট ক্র্যাটার জাতীয় গর্তগুলির মধ্যে একটি হ'ল বিশালাকৃতির হেলাস প্লানিটিয়া। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকারের প্রায় অর্ধেক। গ্রহের দক্ষিণ গোলার্ধে অংশে উত্তর গোলার্ধের চেয়ে বেশি গর্ত রয়েছে। দক্ষিণ গোলার্ধের উচ্চতাও বেশি
মঙ্গল গ্রহে থারসিস বাল্জ নামে একটি এলাকা রয়েছে, যেখানে চারটি বিশাল আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এই আগ্নেয়গিরিগুলি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিস্ফোরিত হয়নি। এগুলোর মধ্যে বৃহত্তম আগ্নেয়গিরিটির নাম অলিম্পাস মনস। এটি ২৭ কিলোমিটার উঁচু। তাই এটিসৌরজগতের সর্বোচ্চ পর্বত। এই পর্বতের উচ্চতা পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও তিন গুণ বেশি। এটি ৬২৫ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত। যা প্রায় মার্কিন অঙ্গরাজ্য অ্যারিজোনার মতো বৃহৎ এলাকা ত। মঙ্গলগ্রহে ভ্যালেস মেরিনারিস নামে একটি বিশাল গিরিখাতও রয়েছে। এটি পৃথিবীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে অনেক বড়। এটি ৪০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৭ কিলোমিটার গভীর এবং ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া। বিজ্ঞানীরা মনে কর যে যখন থারসিস বাল্জ তৈরি হয়েছিল, তখন মঙ্গলের পৃষ্ঠটি ফাটল ধরে ভ্যালেস মেরিনারিস গঠিত হয়েছিল।
পৃথিবীর মতো মঙ্গল গ্রহের মেরুতেও বরফের আচ্ছাদন রয়েছে। এগুলো মূলত হিমায়িত কার্বন ডাই অক্সাইড পাশাপাশি বরফ দিয়ে তৈরি। মঙ্গল গ্রহের শীতকালে বায়ুমণ্ডলে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড জমে যাওয়ার ফলে প্রতিটি মেরুতে বরফের আচ্ছাদন বৃদ্ধি পায়। মঙ্গল গ্রহের গ্রীষ্মকালে আবার এই আচ্ছাদন সঙ্কুচিত হয়ে যায়। পৃথিবীর মতোই মঙ্গল গ্রহের এক মেরুতে যখন শীত কাল হয় তখন অন্য মেরুতে গ্রীষ্ম হয়।
মঙ্গলের কিছু কিছু স্থানে শুকনো খাত রয়েছে। যা দেখে মনে হয় কোনো এক সময় এগুলো প্রবাহিত পানির মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল। সুতরাং, অনেক দিন আগে মঙ্গল গ্রহে হয়তো পানির হ্রদ ও নদী ছিল বলে অনুমান করা হয়। ধারণা করা হয় এখন সমস্ত পানি ভূপৃষ্ঠের নিচে বরফ হিসেবে হিমায়িত হয়ে গেছে।
মঙ্গলগ্রহে একটি বায়ুমণ্ডল রয়েছে, তবে এটি খুব পাতলা। অক্সিজেনের চেয়ে এতে অনেক বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড রয়েছে। (অক্সিজেন হল আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় গ্যাস। শ্বাস নেওয়ার সময় আমরা মূলত এই গ্যাস গ্রহণ করি; অন্যদিকে শ্বাস্তত্যাগের সময় আমরা কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করি।) সুতরাং, মঙ্গল গ্রহ ভ্রমণের জন্য আমাদের স্পেসস্যুটের প্রয়োজন হবে। মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল ছোট উল্কাপিণ্ড থেকে এর পৃষ্ঠকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
মঙ্গল গ্রহ যখন সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসে, তখন বায়ুমণ্ডলের ধুলোর ঝড় সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে কিছু ঝড় বিশা্লাকৃতির হতে পারে। এগুলো পুরো গ্রহকেই ধুলোর মেঘে ঢেকে ফেলতে পারে। মঙ্গলগ্রহে ধুলো-ঝড় শত শত দিন স্থায়ী হতে পারে। এসময় বাতাসের গতি বেগ ঘন্টায় ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে এই ধরণের বিশাল ঝড় দেখা গেছে।
সৌরজগৎ |
ভূমিকা |
শুক্রগ্রহে এক বছর ও এক দিন কতক্ষণ?
সম্পাদনামঙ্গল গ্রহের একদিন পৃথিবীর এক দিনের চেয়ে মাত্র ৩৯ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড বড় (পৃথিবীর ১.০২৬ দিন)। মঙ্গলগ্রহে এক বছর প্রায় দুই পৃথিবী বছর দীর্ঘ (পৃথিবীর ৬৮৭ দিন)।
মঙ্গলের ঘূর্ণন অক্ষ অনেকটা পৃথিবীর মতোই একটি নির্দিষ্ট কোণে হেলানো। এই হেলে থাকার ফলে সূর্যের চারপাশে আবর্তনের মাধ্যমে মঙ্গলগ্রহে ঋতু সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর মতোই সূর্যের চারপাশে আবর্তনকালে গ্রহের যে অর্ধেক অংশ সূর্যের দিকে ঝুঁকে থাকে সেখানে গ্রীষ্মকাল ঘটে। আর বাকি অর্ধেক অংশে শীতকাল ঘটে। মঙ্গল গ্রহের অর্ধেক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ঋতু ঠিক উলটো হয়ে যায়। অর্থাৎ, পৃথিবীর মতোই আগে যেখানে গ্রীষ্মকাল ছিল সেখানে শীতকাল এবং যেখানে শীতকাল ছিল সেখানে গ্রীষ্মকাল ঘটে। তবে এই ঋতুগুলি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দীর্ঘ।
গ্রহটি কী দিয়ে গঠিত
সম্পাদনামঙ্গলের বাইরের পাথুরে পৃষ্ঠকে "ক্রাস্ট" বলা হয়। ভূত্বকের বেশিরভাগ অংশ বেসল্ট থেকে তৈরি। লাভা ঠান্ডা হয়ে গেলে উৎপন্ন হওয়া শিলাই হচ্ছে বেসল্ট।
পৃথিবীর মতো, মঙ্গলগ্রহের ভূত্বকের নিচে পাথরের একটি পুরু স্তর রয়েছে যাকে ম্যান্টল বলা হয়। ম্যান্টল ভূত্বকের চেয়ে অনেক বেশি গরম, এবং ম্যান্টল শিলা আংশিকভাবে গলিত। কিন্তু মঙ্গলগ্রহের ভূত্বক খুব ঘন হয়ে গেছে। তাই ম্যান্টল থেকে লাভা আর পৃষ্ঠে পৌঁছায় না। মঙ্গলগ্রহে আগ্নেয়গিরি রয়েছে, কিন্তু এই কারণেই সেগুলো আর সক্রিয় নয়।
মঙ্গলের কেন্দ্রে লোহা এবং নিকেল ধাতু দিয়ে তৈরি একটি কেন্দ্রমণ্ডল বা কোর রয়েছে। মঙ্গল গ্রহ যদি পৃথিবীর সমান আকারের হত, তবে মঙ্গলের কেন্দ্রমণ্ডল পৃথিবীর কেন্দ্রমণ্ডলের চেয়ে ছোট হত। তাই মঙ্গলগ্রহের একটি বড়ো অংশই শিলা দিয়ে তৈরি। যেহেতু শিলা কেন্দ্রমণ্ডলের ধাতুর চেয়ে হালকা, তাই মঙ্গলগ্রহের ঘনত্ব পৃথিবীর চেয়ে কম।
মঙ্গলে আমি নিজেকে কতটা ভারি অনুভব করব?
সম্পাদনাতুমি যদি মঙ্গলগ্রহে থাকতে, তাহলে তুমি নিজেকে হালকা অনুভব করতে, কারণ মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের দুই পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ, পৃথিবীতে তুমি নিজের যে ওজন অনুভব করবে, মঙ্গলে তুমি সেই ওজনের পাঁচ ভাগের দুই ভাগ অনুভব করবে। সেখানে তুমি পৃথিবীর অনুরূপ বস্তুর তুলনায় প্রায় তিনগুণ ওজনের বস্তুগুলি তুলতে পারবে। আবার তুমি লাফিয়ে প্রায় তিনগুণ উঁচুতে উঠতে পারবে, এবং একই উচ্চতা থেকে মাটিতে পড়তে অনেক বেশি সময় লাগবে।
যদিও দেখে মনে হচ্ছে তুমি মঙ্গলগ্রহে কমিক-বইয়ের নায়কের মতো হবে, তবুও কিছু জিনিস আছে যা তুমি করতে পারবে না। যদিও মঙ্গলে একটি বড় পাথরের ওজন কম হবে এবং তুমি এটি তুলতে পারবে, তবুও এটির ভর একই থাকবে। তুমি যদি এটি ধরার চেষ্টা কর, তোমার হাতে এটি আঘাত করবে। এটি যদি তোমার উপর পড়ে, তাহলে এটি তোমাকে আহত করবে। মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে একটি গাড়ির গতি বাড়ানোর জন্য একই পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে, যদিও চড়াই পথে চলতে কম সমস্যা হবে। তবে, এটি থামানোর জন্য আরও বেশি জায়গা প্রয়োজন হতে পারে। মাধ্যাকর্ষণ কম হওয়ার কারণে একটি যানবাহন মঙ্গলগ্রহের মাটিকে ততটা শক্তিশালীভাবে "গ্রিপ" করবে না, তবে ক্রমাগত ভর যানটিকে ঠিক ততটাই শক্তিশালীভাবে চলতে সাহায্য করবে, যা স্কিডে যাওয়া সহজ করে তুলবে।
কার নামে গ্রহটির নামকরণ করা হয়েছে?
সম্পাদনারোমান পুরাণ অনুসারে "মার্স" যুদ্ধ ও কৃষি দেবতা ছিল। মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠভাগে থাকা পাথরগুলোতে মরিচা ধরে যাওয়ার ফলে গ্রহটিকে রক্তের মতো লাল দেখায়। সেই কারণেই রোমান যুদ্ধ-দেবতা মার্সের নামানুসারেই মঙ্গল গ্রহের ইংরেজি নামকরণ করা হয়েছে।
মঙ্গলের আবিষ্কারক কে ?
সম্পাদনাপ্রায় ৪০০ বছরেরও বেশি আগে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় মঙ্গলের গতিবিধি নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। সেতি ১ নামের একজন ফারাওয়ের সমাধি ছাদে মঙ্গল গ্রহের ছবি আঁকা হয়েছিল। ব্যাবিলনীয়রা (মধ্যপ্রাচ্যে), চীনা এবং গ্রিকরাও ৩০ বছরেরও বেশি আগে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে গবেষণা করেছিল। গ্রিকরা ব্যাবিলনীয়দের কাছ থেকে মঙ্গল গ্রহ সম্বন্ধে জানতে পেরেছিল। ব্যাবিলনীয়রা আকাশে দেখা মঙ্গল গ্রহকে তাদের যুদ্ধের দেবতা বলে অভিহিত করেছিল। তারা এর নাম দিয়েছিল নেরগাল। এর ফলে গ্রিকতা একে তাদের নিজস্ব যুদ্ধের দেবতা আরিস বলে অভিহিত করেছিল। ১৯৬০ সালে মার্স ১ এর মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহ অনুসন্ধানের প্রথম চেষ্টা করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য মিশনের সাথে এটি ব্যর্থ হয়। ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেরিনার ৪ এর মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহে প্রথম সফল মিশন পরিচালনা করা হয়েছিল। মঙ্গল গ্রহে অন্যান্য মেরিনার মিশনগুলোর বেশিরভাগই সফল হয়েছিল। মঙ্গলগ্রহে শেষ মেরিনার মিশন মেরিনার ৯ ধুলোঝড়ের মধ্যে সেখানে পৌঁছেছিল, এবং ভূপৃষ্ঠের দিকে ভাল ভাবে দেখার আগে বেশ কয়েক মাস ধরে গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করেছিল। এই পর্যন্ত এই সমস্ত মিশন ফ্লাইবাই বা অরবিটার ছিল। মঙ্গল গ্রহে অবতরণকারী প্রথম মহাকাশযান ছিল ১৯৭৬ সালের ভাইকিং ১। ভাইকিং ২ ১৯ দিন পরে অবতরণ করে। একসাথে, তারা মঙ্গলের পৃষ্ঠের অনেক ভালো ছবি তুলেছিল।